সচিবালয় এবং এনবিআর এ যেন এক সোনার হরিণের গল্প। দুর্নীতি আর চোরাকারবারি মহা ক্ষেত্রে। সামান্য পিয়নও যেন কোটি টাকার মালিক বনে যায় এক গায়েবি লিলা খেলায়।
দীর্ঘ ১৫ বছর খুনি হাসিনার মদদে চলা ভারতের কলোনাইজেশন যেখানে ছিলো না কোনো সত্য দেখা,শোনা কিংবা বলার অধিকার। ২০২৪ এর জুলাই ছাত্র-জনতার গনঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পালাবদল। এরই ধারাবাহিকতায় ড. ইউনুস স্যার প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দেশের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠ হন। এসেই শুরু হয় দেশ সংস্কার এর কার্যক্রম।
যার দরুন বাংলাদেশ সরকার ২০২৫ সালের ২৬ মে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে, যা সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর সংশোধন হিসেবে কার্যকর হয়েছে ।
নতুন অধ্যাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য চারটি আচরণকে অসদাচরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে:
১. অনানুগত্য বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের মতো কাজে লিপ্ত হওয়া বা অন্যদের এমন কাজে প্ররোচিত করা।
২. ছুটি ছাড়া বা যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকা বা কর্তব্যে অবহেলা করা।
৩. অন্য কর্মচারীদের কর্মবিরতি বা কর্তব্যে অবহেলার জন্য উসকানি দেওয়া।
৪. অন্য কর্মচারীদের কর্তব্য পালনে বাধা প্রদান করা ।
এই অপরাধগুলোর জন্য শাস্তি হিসেবে নিম্নপদে অবনমন, চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।
শাস্তি প্রক্রিয়া ও আপিল:
- অভিযোগ গঠনের সাত দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হবে।
- অভিযুক্ত কর্মচারীকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে আরও সাত কর্মদিবসের মধ্যে শাস্তির কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হবে।
- শাস্তি আরোপের পর, দণ্ডিত কর্মচারী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে আপিল করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না, যদিও পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করা যাবে ।
NBR(National Board of Revenue) এর সংস্কার কার্যক্রম হিসাবে ২০২৫ সালে বাংলাদেশের রাজস্ব খাতে একটি বড় ধরনের সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ গঠন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে: রাজস্ব নীতি বিভাগ (Revenue Policy Division – RPD) এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ (Revenue Management Division – RMD)।
সংস্কারের মূল বৈশিষ্ট্য:
দুটি নতুন বিভাগ: ২০২৫ সালের ১৩ মে জারি করা “রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫” অনুযায়ী, এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (IRD) বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
রাজস্ব নীতি বিভাগ (RPD): এই বিভাগের দায়িত্ব হবে কর নীতিমালা প্রণয়ন, রাজস্ব সংক্রান্ত গবেষণা ও আন্তর্জাতিক চুক্তি মূল্যায়ন।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ (RMD): এই বিভাগ রাজস্ব সংগ্রহ, শুল্ক ও ভ্যাট বাস্তবায়ন, এবং সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করবে।
কর্মচারীদের প্রতিক্রিয়া :
উক্ত অধ্যাদেশটি জারির পর থেকেই সরকারি কর্মচারীরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছেন। তাদের দাবি, এই অধ্যাদেশ কর্মচারীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও আন্দোলনের অধিকার হরণ করে। তারা এটিকে ‘কালো আইন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
এই সংস্কার উদ্যোগের বিরুদ্ধে এনবিআর-এর কর্মকর্তারাও তীব্র প্রতিবাদ জানান। তারা এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত বাতিল, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খানের অপসারণ, এবং রাজস্ব সংস্কার উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশ প্রকাশের দাবি জানান। এই দাবিতে তারা ১৪ মে থেকে কলম বিরতি ও পূর্ণ কর্মবিরতি পালন করেন, যা দেশের রাজস্ব আদায় ও বাণিজ্য কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
সোমবার (২৬ মে) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নতুন ভবনের নিচে আয়োজিত জরুরি সমাবেশে এ কর্মসূচির ঘোষণা করেছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘ঐক্য ফোরাম’ এর নেতারা। ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের আরেকাংশের সভাপতি মুহা. নূরুল ইসলাম বলেন, সারা দেশের কর্মচারীরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
বিশ্লেষণ :
২০২৪ এর জুলাই আন্দোলনের সময় যখন দেশবাসী সাক্ষী হচ্ছিলো এক নরপিশাচিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের,ঠিক তখন-ই সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের আষ্টেপৃষ্টে গড়ে ওঠা এই গৃহপালিত আমলাকূল সেই নির্মম গণহত্যাকে সমর্থন দিয়ে খুনি হাসিনার পক্ষ অবলম্বন করে কালো ব্যাচ পরে খুনি হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছিলো। আজ যখন আওয়ামী লীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে তখন যেন তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ড. ইউনুস স্যারের সংস্কার কর্যক্রমকে বাধা দেওয়ার জন্য সকল পায়তারা ও ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে তারা। এর প্রেক্ষিতে জুলাই আন্দোলনের প্রথম সারির সমন্বয়ক এবং NCP এর দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন,ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার টিকে গেলে আপনারা ঠিকই পদলেহন করে চাকরি করতেন। সুতরাং ৫-ই আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে আপনারা যদি জনগণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ সরকারকে হুমকি দেন ও সংস্কার কার্যক্রমে বাধা দেন, তবে মনে রাখবেন, জনগণই আপনাদের বিকল্প খুঁজে নেবে। হাসনাত বলেন, ‘৫ই আগস্টের আগে কোনো সচিব, কোনো আমলা বা কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কি পদত্যাগ করেছেন। একজনও কি পদত্যাগ করেছেন। রাস্তার মধ্যে নাগরিকদের যে এভাবে গুলি করে হত্যা করছিল, তখন কি একজন সচিব বা আমলার পদত্যাগের খবর এসেছিল? কিন্তু এই সরকারের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর তারা সহযোগিতা না করে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। সরকারকে জিম্মি করলে পরিস্থিতি ভালো হবে না বলে মন্তব্য করেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির এর কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক মোহাম্মদ নাঈম বলেন,’বাংলাদেশে দুর্নীতির সবচেয়ে বড় আখড়া হচ্ছে এনবিআর। এদের যোগসাজশে হাজার হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি ও দুর্নীতি হয়। সচিবালয়ের পিয়নের শত কোটি টাকার সম্পদের চিত্র আমরা দেখেছি। এই দুই জায়গায় সংস্কার করতে না পারলে, দেশের সার্বিক সংস্কার কখনোই সম্ভব হবে না।কঠোর হন,প্রয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি করুন, অধ্যাদেশ প্রয়োগ করুন। দুর্নীতিবাজদের ছাঁটাই করুন। দুদককে কাজে লাগিয়ে সম্পদের হিসাব চান। তারা ঠান্ডা হতে বাধ্য হবে।’
উক্ত আমলাদের এই বিভ্রান্তমূল দাবি ঠেকাতে ইতিমধ্যে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন ফ্যাসিবাদ বিরোধী সকল ঔক্য জোট। সচিবালয়ের সংস্কারবিরোধী আমলাদের অপসারন ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের দাবিতে ‘গণসমাবেশ’ এর ঘোষণা দিয়েছেন তারা আব্দুল গণি রোড (ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সামনে)। যার সময় তারা ২৭ মে ২০২৫, সকাল ১১:৩০ মিনিট নির্ধারণ করেছেন।
সরকারি কর্মচারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা রাষ্ট্রের একটি বড় সংস্কার । এই সংস্কার কার্যক্রমকে যারা বাধাগ্রস্থ করতে চায় তারাই মূলত ফ্যাসিবাদ জিইয়ে রাখতে চায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন নেটিজেনরা বলছেন, জনগণের উচিত সরকারের পাশে দাড়ানো এবং এদের প্রতিহত করতে নানান কর্মসূচি দেওয়া। যদিও প্রথম সারির বৃহৎ রাজনৈতিক দলসমূহ এখনো এই বিষয় নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। রাজনৈতিক দলদের পরবর্তী পদক্ষেপেই নির্ধারণ করে দেবে কারা ফ্যাসিবাদ প্রথা বিলুপ্তি চায় আর কারা জিইয়ে রাখতে চায়।
শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
