Thursday, June 1, 2023
বাড়িগল্পজীবন নদীর বাঁক-বদল

জীবন নদীর বাঁক-বদল

দীর্ঘ এক মাস যাবৎ মুনিযা হাসপাতালের বিছানায় জীবন কাটাচ্ছে। এটা শুনে সবার মনে হতে পারে, সে খুব কঠিন সময় পার করছে। আসলে তা, না। হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে তার সময় তুলনামূলকভাবে ভালো কাটছে। একটু আগে আরিফ আংকেল তাকে দেখতে এসে কেঁদেকেটে বিশ্রী অবস্থা করলেন। মুনিযার সেটাও ভালো লাগল। যদিও সে তার ভালোলাগাটুকু প্রকাশ করতে পারল না। কারণ তার মস্তিষ্ক কর্মক্ষম হলেও শরীর অবশ। আরিফুল হককে দেখামাত্র তার সেদিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। মাসখানেক আগে শ্যামলীতে সাইকিয়াট্রিস্ট আরিফুল হক চৌধুরীর চেম্বারে গিয়েছিল মুনিযা। তাকে দেখতে অন্যান্য দিনের মতো চটপটে লাগছিল না। দুপুরের পর বিশ্রাম না নিয়ে ওখানে চলে যাওয়ায়, বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। এর সাথে চেহারায় যোগ হয়েছিল অকৃত্রিম গাম্ভীর্য্যের ছাপ। আরিফুল হক অনেকক্ষণ সময় দিয়েছিলেন মুনিযাকে। তবু সে নিজেকে গোছাতে পারছিল না। তার কাছে আরিফুলের কাছে আসাটা তখন হাস্যকর লাগছিল। অথচ গত এক মাস নিদারুণ যন্ত্রণাময় পরিস্থিতির শিকার হয়ে সে, গত রাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই বৃদ্ধার শরণাপন্ন হবে। রাতে যে জিনিসটা অতীব জরুরি মনে হয়, দিনের

বেলা সেটা নিমিষেই হালকা বিষয় হয়ে যায়! মুনিযার অতিরিক্ত গাম্ভীর্যের কারণ হলো, সে আরিফুল হককে কী বলবে, কীভাবে বলবে তা বুঝতে পারছে না! সে নিজেও একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। প্রত্যেকদিন যেসব কথা মানুষের কাছে তাকে শুনতে হয়, তাদেরকে যেভাবে কনসোল করতে হয়, সেই একই কথা এই লোককে সে বলবে। একই সলিউশন উনি দিবেন। এর কোনো মানে হয়! এসেই যখন পড়েছিল, ভদ্রতার খাতিরে এক কাপ চা আর অল্পবিস্তর কিছু গল্প করে উঠে যাওয়াই ভালো বলে মনে করেছিল মুনিযা। আরিফুল হক যেন তার মনের খবরটা বুঝেছিলেন।

‘তোমার তো খুব চা খাওয়ার বাতিক আছে, চা খাবে?’

‘হ্যাঁ চায়ের কথাই ভাবছিলাম, স্যার।’

আরিফুল হক দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিয়েছিলেন। মুনিযা গাম্ভীর্য কাটিয়ে প্রত্যেকদিনের কৃত্রিম হাসিটাকে পাশ কাটিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা শুরু করেছিল।

‘স্যার, আমি আসলে ভাবছি আপনাকে আমার কোন সমস্যাটার কথাটা বলব! আমার মূলত কোনো সমস্যা নেই। নিয়মিত রোগি দেখছি। তাদেরকে কনসোল করছি। জীবনে

কোনো ঝামেলা নেই। নিজের মতো চলছি। একদম নির্ভেজাল এবং নিস্তরঙ্গ জীবন।’

‘নিস্তরঙ্গ জীবন কথাটা কি ঠিক? আমি যতটুকু জানি তুমি খুবই সুখী একটা জীবন যাপন করছ।’

‘এখানেই সমস্যা,স্যার। এই সমস্যাটাই বেশি গুরুতর। একটা স্বাভাবিক নিস্তরঙ্গ নদীকে সহজেই আন্দোলিত করা যায়। কিন্তু যে নদী সবসময় উত্তাল থাকে, সেটাকে আন্দোলিত করতে সুনামির প্রয়োজন হয়। আমার সমস্যাটা আমি বেশ ভালো করে জানি, স্যার। মাত্র একুশদিনের ডোপামিন ডিটক্সই আমাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট । কিন্তু এই একুশ দিন সময়টা এত দীর্ঘ মনে হয়,যেন একুশ শতাব্দী! আমার মনে হয়,এতটা সময় পার হওয়ার আগেই আমার জীবনের মেয়াদ ফুরাবে!’ আরিফুলের খুব মায়া লাগল। কী সুন্দর করে গুছিয়ে নিজের সমস্যার পাশাপাশি সমাধানটা বলে যাচ্ছে অল্পবয়সী এই তরুণী! সমস্যা, সমাধান দুটো জানা থাকলে সত্যিই বিপদ। কোনো পথেই এগুনো যায় না। মুনিযার সমস্যাটা উনাকেও পেয়ে বসতে পারত। উনার বয়স সেই সুযোগটা দেয়নি। তরুণ হলে উনিও বেসামাল হয়ে যেতেন। আরিফুল চেয়ার ছেড়ে উঠে মুনিযার মাথায় হাত রাখলেন।

‘আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আরও খারাপ লাগছে তোমার মতোই একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিজেকে মেলে ধরতে হবে বলে। এর কোনো প্রয়োজন নেই।কষ্ট যত বড়ই হোক এর থেকে একদিন না একদিন মুক্তি ঘটে। আর সৃষ্টিকর্তা কাউকে এমন কোনো কষ্ট চাপিয়ে দেন না, যা সে সইতে পারে না। তোমার সব অস্থিরতা দূর হয়ে যাবে, মা। সব সল্যিউশন তো তোমার জানাই, আমি শুধু তোমার জন্য দোয়া করব।’

‘স্যার, আপনি আমার সিনিয়র৷ কিন্তু আপনার চাইতে হয়তো আমি বেশি রোগি হ্যান্ডেল করেছি। আমি আপনার কাছে এসেছি, আপনি একটা গর্বের জায়গা থেকে আমাকে কনসোলের চেষ্টা করছেন। মন থেকে আমার জন্য দোয়া করবেন, আমি জানি। কিন্তু স্যার, আমার গর্ব, আত্মসন্তুষ্টির জায়গাটা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। যত প্রশংসা শুনছি মনে হচ্ছে নিজেকে কতটা বিলিয়ে দিয়েছি, সেটাই সবাই তুলে ধরছে।’

মুনিযা ফুঁপিয়ে উঠল। অশ্রুর সাথে যেন সবার উপর জমিয়ে রাখা অভিমানটা ঝরে পড়ছে।

‘আমি কখনো কারো উপর রাগ ঝাড়তে পারি না,স্যার। বলতে পারি না আমার মন খারাপ! সবাইকে কনসোল করার পর নিজের শান্তির জায়গাটা খুঁজে পাই না। সবার সাথে মানিয়ে নিতে নিতে, আমি আর কিছু মেনে নিতে পারছি না। আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না, স্যার। এই সফল জীবন, এত নামি- দামি মানুষের ভীড়, এত আনন্দ, প্রশংসা, প্রাপ্তি, ভালো খাওয়া-আড্ডা সব কিছুর উপর থেকে মন উঠে গেছে। এমন কৃত্রিম সুখী জীবনের চাইতে এক বোতল বিষ খাওয়া কিংবা একমাসের জন্য কোমায় চলে গিয়ে অনুভূতি শূন্য হয়ে যেতে পারলে হয়তো বেশি ভালো থাকতাম!’

আরিফুল হক কী বলবেন বুঝে পাচ্ছিলেন না! নিজেকে বড্ড আনাড়ি আর তুচ্ছ মনে হচ্ছিল এই মেয়ের সামনে। মনের মাঝে গভীর বেদনা অনুভব করছিলেন মুনিযার জন্য৷ চা এলে নিরবে দুজন চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলেন। আরিফুল হক বাইরের জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নিজের বেলা সবাই অবুঝ৷ তবে তুমি নিজের বেলাতেও অনেকটা বোঝার ক্ষমতা রাখো। এগুলো ডায়েরিতে লিখতে পারো নিয়মিত। সামান্য হলেও অবশ্যই উপকৃত হবে।’

মুনিযা সোনালি রঙের বাইন্ডিং করা একটা নোটবুক ব্যাগ থেকে বের করে বলেছিল, ‘এই যে, এখানে গত এক মাসের প্রত্যেকদিনের কথা জমা রেখেছি৷ এজন্য এখনো পুরোপুরি ভারসাম্যহীন হয়ে যাইনি। আমি আপনাকে আমার সমস্যা না বলে এই লেখাগুলোই দেখাতাম। কিন্তু সেই ইচ্ছাটা এখন আর নেই! আমি উঠি স্যার। আপনার সাথে কথা বলে অল্প হলেও ভালো লেগেছে। আসসালামু-আলাইকুম।’

চেম্বার থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠেছিল মুনিযা। সে সমস্ত জীবনের হিসেব-নিকেশ করেছে গত এক মাস। চাওয়া পাওয়া সব কিছুর হিসাব নির্ভুল। জীবনের সব চাওয়া তার পূরণ হয়ে গেছে। সব ইচ্ছা পূরণ হলেই বোধহয় এই স্থায়ী বিষণ্ণার তা সৃষ্টি হয়। জীবনের কাছে তার আর কিছু চাওয়ার নেই! কী অসম্ভব কঠিন রোগ! বিকাল গড়াচ্ছে  রিকশা চলছিল রিংরোড ধরে।

তার চাওয়ার একটা জিনিস অবশ্য আছে, বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পাওয়া। শুধুমাত্র এই একটা চাওয়াই হয়তো পূরণ হবার না। রাস্তার পাশের কয়েকজন গার্মেন্টস কর্মীকে দেখে তার হিংসা হয়েছিল। তারা বাসায় ফিরে কতশত গল্প করবে। কত রকম রসিকতা থাকবে সেসব কথায়। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমিকের সাথে কথাও বলবে কয়েকজন। কিংবা ডালভাত, লেবু দিয়ে মেখে খেয়ে রাতে শান্তিতে ঘুমাবে। তার জীবনে কথা বলার মানুষের অভাব নেই, খাবার দাবারের অভাব নেই, আরাম-আয়েশ করারও যথেষ্ট সরঞ্জাম আছে। শুধু একটা জিনিসের অভাব; ইচ্ছার অভাব। তার কিছুতে মন বসে না। কিচ্ছু ভালো লাগে না। সবার সাথে তার খুব সুখী একটা চেহারার যোগাযোগ। ভেতরের যন্ত্রণাগুলো প্রকাশের মঞ্চ একমাত্র প্রকৃতি। সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পাওয়া মেঘ, বৃষ্টি, বাতাসের কাছে সে নিজেকে সঁপে দিত। কিন্তু, আজকাল তার প্রকৃতির সান্নিধ্যও ভালো লাগে না। গান বাজনা কিছুতে মন বসে না। পৃথিবী খুব আশ্চর্যজনক জায়গা। এখানে মানুষ যখন কোনো অনুভূতির শিখরে উঠে যায়, তখন হঠাৎ করেই জীবনের  ছন্দ পালটে যায়। কে জানত মুনিযার বিষণ্ণতা থেকে মুক্তির ইচ্ছা পূরণের জন্য জীবনের মোড়টা সৃষ্টিকর্তা এত তাড়াতাড়ি বদলে দেবেন!

রিকশা ছেড়ে এলোমেলো পায়ে হাঁটছিল মুনিযা। ঠিক তখন হর্নের তীব্র শব্দ তার কানে বাজল। ভেতরে তখন প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে মুনিযার। মনে হচ্ছে, হর্ন দিচ্ছে যে গাড়িটা সেটা তার উপর দিয়ে চলে গেলে যন্ত্রণার অবসান হবে। মুনিযা হর্নের শব্দকে তোয়াক্কা না করে মনে প্রাণে চাইল তাকে এই গাড়িটা পিষে যাক। এতে করে যদি যন্ত্রণা তাকে ছাড়ে! হলোও ঠিক তাই। প্রাইভেট কারের সাথে ধাক্কা খায় মুনিযা। বড়সড় এই এক্সিডেন্টে তার মাথায় সবচাইতে বেশি রক্তক্ষরণ হয় । ফলে সে ভেজিটেটিভ স্টেটে চলে যায়। এক মাস ধরে সে হস্পিটালাইজড। তার মস্তিষ্ক সজাগ আছে, কিন্তু চেতনা দিয়ে বা স্বেচ্ছায় কিছু করতে পারে না।ব্যস্ততা, কোলাহলের ভীড়ে থাকতে থাকতে তার প্রচণ্ড একা লাগার মতো অনুভূতিগুলো এখন অপরিচিত হয়ে গেছে। বাবা, মা,আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষীদের হাসপাতালে নিত্য আসা যাওয়া, তাদের মুখে তার জন্য নিজেদের মতো করে বলা কথাগুলো শুনতে তার বেশ লাগে। সবচাইতে খুশি হয়েছিল মুনিযা কয়েকদিন আগে। তার আমেরিকা প্রবাসী  মানসিক চাপে বিপর্যস্ত বান্ধবী সোহানার ট্রিটমেন্ট সে অনেক বছর আগে করেছিল। সুস্থ থাকাকালীন সময়ে সোহানা তেমন খোঁজ নিত না। কিন্তু সেই বান্ধবী তার এক্সিডেন্টের খবর জানার পর আমেরিকা থেকে চলে এসেছে তাকে দেখতে! কী যে ভালো লেগছিল মুনিযার সেদিন! তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল টুপটাপ। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় যে অসুখী হাসিমুখের মুনিযাকে দেখে হিংসা করত, তারা আফসোস করছে তাকে এই অবস্থায় দেখে। অথচ একমাত্র মুনিযা জানে তার সুস্থ থাকাকালীন মূহুর্তগুলোর চাইতে এইভাবে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকার জীবন অনেক সুখের। তাকে ঘিরে মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, মমতা তার ভাল্লাগে না অসুখটাকে সারিয়ে দিচ্ছে অল্প অল্প করে। সবার চোখে যেটা ‘কী খারাপ ভাগ্য’ মুনিযা জানে সেসব ভয়ংকর ভালো না লাগার দিনের চাইতে হাজারগুন ভালো এই ভাগ্য। এই এক্সিডেন্টটাকে সবাই ভাবে মুনিযার জীবনে অভিশাপ। শুধুমাত্র সে নিজে জানে এই দুর্ঘটনাটা তার জীবনে কত বড় আশীর্বাদ। থমকে যাওয়া জীবনকে সচল করেছে এই দুর্ঘটনা। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, মুনিযা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। তার বাঁচার ইচ্ছাটা দিন দিন প্রবল হয়ে উঠছে। মনোবিজ্ঞানী মুনিযাও জানে, তার বাঁচার ইচ্ছা আবার জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু সেটা সুস্থ না হয়ে এখানে শুয়ে থেকে সমস্ত পৃথিবীটাকে সামনে নিয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছা। মাঝে মাঝে সুস্থ হয়ে অসুখীর মতো বেঁচে থাকতে হবে ভাবলেই সে অসুস্থ হয়ে যায়! মাঝে মাঝে অসুস্থতার সুখ এত মধুর মনে হয়! পৃথিবীর স্বাভাবিকতার উপর রাগ থেকে মুনিযার মাসের পর মাস আর তথাকথিত সুস্থ হয়ে উঠা হয় না। তবে সবার অলক্ষে সে সুখী থাকে। কল্পনায় শ্রাবণের বৃষ্টি, ভোরের শিউলী ফোটা ভোরের স্নিগ্ধতা অনুভব করে। তার মানুষের সামনে মেকি সুখী সুখী ভাব করতে হয় না। হাজার জনের মনের চাপ সামলে, নিজের মনের চাপ বাড়ানোর ঝুঁকি নেই। কাছের মানুষের নিয়মিত সাহচর্যে  ‘ভাল্লাগে না’ রোগটাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মনে মনে স্বার্থপরের মতো হেসে পৃথিবীকে সে ধন্যবাদ দেয়। ভেতরের  রূপটা খুলে না দেখালে পৃথিবীবাসী সেটা কখনোই বুঝতে পারে না। পৃথিবী সত্যিই চমৎকার জায়গা। এখানে সবই সম্ভব! মন থেকে চাইলে, জীবন এখানে  বাঁক-বদল করে বিচিত্রভঙ্গিতে  সুন্দর হয়ে ধরা দেয়!

লেখকঃ মুনিয়া রশীদ চৌধুরী

শিক্ষার্থী, বৃন্দাবন সরকারি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
সম্পর্কিত প্রবন্ধঃ

মন্তব্য বাদ দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন

সবচেয়ে জনপ্রিয়