আপনি কি পান খান ? উত্তরঃ না , আমি পানাহারে অভ্যস্ত নই । ব্যাকরণের ভাষায় উত্তরটি সঠিক , কিন্তু ভাবের দিক থেকে অর্থহীন । একটি বিয়ের অনুষ্ঠানও অনেক সময় অর্থহীন হয়ে যায় যদি ভুঁড়ি ভোজনের পর সেখানে পান সুপারির আয়োজন না থাকে ।
পান সুপারির ব্যাবহার প্রায় চার হাজার বছরের । পৃথিবীর কয়েকটি শহর সুপারির নামে নামকরণ করা হয়েছে । যেমন- ভারতের গোয়াহাটি , মালয়েশিয়ার পেনাং ইত্যাদি । পূর্ব আফ্রিকা, ভারত উপমহাদেশ থেকে শুরু করে তাইওয়ান পর্যন্ত প্রায় ৬০ কোটি লোক পান সুপারি খেয়ে থাকেন । ভারত , মায়ানমার , ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ চতুর্থ সুপারি উৎপাদনকারী দেশ । পান সুপারি খেলে শরীর কিছুটা গরম হয় , কর্মদক্ষতা ও মনের সতর্কতা বৃদ্ধি পায় । যেমন, একজন ড্রাইভার গাড়ি চালানোর সময় ঘুম পেলে গাড়ি থামিয়ে একটি পান খেয়ে নেন , তাতে তার ঘুম চলে যায় ।
পান সুপারি ও রকমারি জর্দার গুনাগুণ নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নানারকম প্রচারণা করে থাকে । এমনকি কোন কোন প্রখ্যাত আলেমও এগুলোর মধ্যে অনেক উপকারিতা খুজে পেয়েছেন (বেহেশ্তি জেওর, নবম খণ্ড। হিন্দু ধর্মের ও বৌদ্ধ ধর্মের কোন কোন শাখার কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পান-সুপারির ব্যাবহার অপরিহার্য বিবেচনা করা হয় । পান সুপারি সহজলভ্য এবং সস্তা । এর ব্যাবহারও ব্যাপক । কোন বৃদ্ধ লোকের দাঁত নড়বরে বা না থাকলে পান সুপারিকে হামাম দিস্তা দিয়ে গুড়ো করে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় । তবুও পান তার খাওয়া চাই । আমার এক আত্মীয়া প্রায় প্রতি ঘণ্টায় পান খান । একদিন হঠাৎ পান ফুরিয়ে গেলে রাত এগারোটায় প্রতিবেশীনীর বাসায় গিয়ে হাজির ‘পান ভিক্ষার’ জন্য । তিনি তো রীতিমত অবাক । কোনদিন তার এই প্রতিবেশীনি কোন কিছু চাইতে আসেননি । পানের জন্য এত রাতে হাজির! অর্থাৎ পান সুপারি নির্ভরশীলতা তৈরি করে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে না খেলে প্রত্যাহার জনিত সমস্যা (Withdrawl Syndrome) বা নানারকম শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হয় । আমার এক বন্ধু ঘুম থেকে উঠে পান না খেলে প্রাতক্রিয়া করতে পারেননা । আরেকজন রোগী পান ফুরিয়ে গেলে মাঝ রাতে পানের দোকানদারকে বাধ্য করেন দোকান খুলতে । কয়েকজন রোগীর সাথে আলাপচারিতায় জানা যায় যে, তারা সিগেরেট ছাড়তে সক্ষম হয়েছেন কিন্তু পানের নেশা ছাড়তে পারেননি ।
পান-সুপারির উপকারিতা নিয়ে বৈজ্ঞানিক কোন গবেষণা হয়নি । এর অপকারিতার উপর অনেক গবেষণা হয়েছে । পানের সাথে যে উপাদানগুলো ব্যাবহার করা হয় তা হচ্ছে সুপারি , চুন , খয়ের , জর্দা , লবঙ্গ ইত্যাদি । এই উপাদানগুলোর অধিকাংশই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ।
সুপারিঃ এতে এরেকোলিন(Arecoline) , এরেকাইডিন (Arecaidine) , গাভাকাইন(Gavacaine)সহ বেশ কিছু ক্ষারজাতীয় পদার্থ রয়েছে যা রক্তনালীকে সংকুচিত করে । সুপারিতে এডরেনালিন আছে । ফলে নিয়মিত ও অতিরিক্ত সুপারি ব্যাবহার করলে উচ্চরক্তচাপ , বুক ধড়পড় করা , ডায়েবেটিস বেড়ে যাওয়া , হাঁপানি বৃদ্ধি পাওয়া এবং হৃদরোগের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে । আসলে সুপারি প্রতিটি অঙ্গকে ক্ষতি করতে পারে । লিভার ইনজুরি , কিডনি রোগ , বিপিএইচ , ইনফার্টালিটি , হাইপারলিপিডোমিয়া , রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া , মানসিক রোগ বৃদ্ধি পাওয়া , দাঁতের মাড়ি ক্ষয় ও দাঁত পরে যাওয়া ইত্যাদির সাথে সুপারি জড়িত । গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে অকালে বাচ্চা প্রসব (Preterm birth) , বাচ্চার ওজন ও উচ্চতা কম হতে পারে । সুপারির সাথে মেটাবলিক সিন্ড্রোম ও Obesity বা স্থূলতা জড়িত । সুপারির সাথে ক্যান্সারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিকে কারসিনোজেন (ক্যান্সারের উপাদান) হিসেবে উল্লেখ করেছে । আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা (IARC) সুপারিকে ১৯৮৫ সাল থেকে কারসিনোজেন হিসেবে গণ্য করে আসছে । ২০০৯ সালে ৩০ জন বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থায় নিশ্চিত করেছে যে সুপারিতে ক্যান্সার জীবাণু রয়েছে । পৃথিবীর যেসব এলাকায় সুপারি ব্যাবহার করা হয় বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে মুখের ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি । এই অঞ্চলে এক লাখ লোকের মধ্যে ২০ জনের এবং সব ধরণের ক্যান্সারের মধ্যে শতকরা ৩০ জনের শুধু মুখের ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার হয়ে থাকে । আমারই পরিচিত তিন জন আলেম ছিলেন যারা প্রচুর পান-সুপারি খেতেন এবং তারা মুখের ও খাদ্যনালীর ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেছেন । যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি (CDC) একটি নির্ভরযোগ্য, গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান । এই প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ি বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারন হচ্ছে ক্যান্সার ।
সিডিসির তথ্য অনুযায়ী সুপারির সাথে Oral submucous fibrosis , মুখের ক্যান্সার , নেশা (Addiction) , প্রজনন সমস্যা ইত্যাদি জড়িত । যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এফডিএ (FDA) সুপারিকে বিষাক্ত গাছের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং সুপারিকে চাবানো বা খাওয়ার জন্য নিরাপদ মনে করে না ।
চুনঃ বা ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড পান সুপারির সাথে অল্প পরিমান ব্যবহার করা হয় । এতে মুখগহ্বরের পিএইচ (Ph) ১২.৫ এর উপরে উঠে যায় ফলে সুপারির পূর্বে উল্লেখিত ক্ষারজাতীয় পদার্থগুলো জিহ্বার নিচে দিয়ে সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে । চুন মুখে কেমিক্যাল বার্ন বা ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে । ঘন ঘন পান খাওয়ার সাথে অতিরিক্ত চুন সেবনে হাইপারক্যালসেমিয়া , মেটাবলিক এলকালসিস , মিল্ক এলকালি সিন্ড্রোম ,কিডনি ইনজুরি এবং কিডনিতে পাথর হতে পারে ।
জর্দাঃ পান-সুপারি ও চুনের সাথে জর্দার সংযোজন সাম্প্রতিক সময়ের; অ্যামেরিকা মহাদেশ থেকে তামাক আমদানির পর থেকে । জর্দা এই তামাক পাতা থেকে তৈরি করা হয় । তামাকে ২৮টি কার্সিনোজেন (ক্যান্সারের উপাদান) রয়েছে । বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে পৃথিবীর প্রায় ১/৩ ভাগ মানুষ তামাক সেবন করে থাকে । এর মধ্যে প্রায় ১১% ধোঁয়াযুক্ত তামাক (সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদি) সেবন করে থাকে এবং প্রায় ২২ % ধোঁয়াবিহীন তামাক (SLT) যেমন জর্দা , গুল ইত্যাদি ব্যাবহার করে থাকে । এতে ধোঁয়াযুক্ত তামাকের চেয়ে নিকোটিনের পরিমাণ ৩/৪ গুণ বেশি । কাজেই জর্দার ক্ষতি সিগারেটের চেয়েও বেশি হতে বাধ্য । ল্যাবরেটরিতে প্রাণীদের উপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে নিকোটিন প্রায় প্রতিটি অঙ্গে ক্যান্সার করতে পারে ।
খয়েরঃ এর মধ্যে ১২ ধরণের রাসায়নিক পদার্থ আছে। খয়েরের অত্যধিক ব্যাবহার লিভার ইনজুরি করতে পারে এবং এতে শরীরের রক্তচাপ কমে যেতে পারে ।
পানঃ এর মধ্যে ইউজেনল (Eugenol) রয়েছে যা রক্তনালীকে সংকুচিত করতে পারে । পানের মধ্যে ভিটামিন সি , এন্টিঅক্সিডেন্ট,রেচক ইত্যাদি থাকতে পারে । তবে ‘বিষাক্ত গাছের ফল’ (সুপারি) খেলে পানির এন্টিঅক্সিডেন্ট বা ভিটামিন সি আপনার কিইবা উপকার করবে ?
উপরের আলোচনা থেকে আশা করি স্পষ্ট হয়েছে যে সহজলভ্য ও সস্তা পান সুপারি আমাদের জন্য ব্যয়বহুল ক্যান্সার রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে দিচ্ছে । অন্যান্য মাদকদ্রব্যের মত পান সুপারিও নির্ভরশীলতা (Dependency)এবং প্রত্যাহার উপসর্গ (Withdrawl Syndrome) তৈরি করে । পৃথিবীতে নিকোটিন (বিড়ি ,সিগারেট) , মদ , ক্যাফেইন (কফি) এর পর পান সুপারি হচ্ছে চতুর্থ বহুল ব্যবহৃত নেশা সৃষ্টিকারী বস্তু। অথচ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হওয়ার পরও পান-সুপারি বা পান মাসালা হচ্ছে অবহেলিত একটি আলোচ্য বিষয় । এই উপমাহাদেশের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে সরব হচ্ছেন । অস্ট্রেলিয়াতে সুপারির ব্যাবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে । সংযুক্ত আরব আমিরাতে এর ব্যাবহার নিষিদ্ধ এবং পান খাওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ । থাইল্যান্ডে শিক্ষিতদের মধ্যে পান-সুপারির ব্যাবহার অনেক কমে যাচ্ছে । তাইওয়ান বছরে একদিন ‘সুপারি প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে থাকে এবং সরকারিভাবে কৃষকদেরকে সুপারি উৎপাদন না করার জন্য নানারকম প্রণোদনা দিচ্ছে । আমাদেরও সময় এসেছে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করার।
প্রফেসর কর্নেল ডাঃ জেহাদ খান (অব.)
মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ