বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গেজেট হয়েছে ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। প্রায় এক বছর এর বয়স। এ এক বছরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র গ্রহণ কিংবা অনুমোদনের জন্য নকশা দাখিলের পরিমাণ খুব আশাব্যঞ্জক নয়। নগরবাসীর কেমন একটা দ্বিধা কাজ করছে। আমার নিজেরও এ গেজেট প্রকাশের সময় থেকেই অনেক প্রশ্ন মনে জেগেছে, কিন্তু কোথাও কোনো সদুত্তর পাচ্ছি না। সবাই কিছু একটা লুকাচ্ছে কিংবা এড়িয়ে যাচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে।
এক. গেজেট নিয়ে প্রশ্ন
আমার অতি ক্ষুদ্র পড়াশোনা বলে, কোনো অঞ্চলের মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা আর ড্যাপ দুটো এক নয়; একেবারে ভিন্ন বিষয়। দুটি ক্ষেত্র প্রণয়নের জন্য অগ্রবর্তী হওয়ার ধারাবাহিকতা একদম ভিন্ন।
টিআই অ্যাক্টের আওতায় কোনো মহাপরিকল্পনা প্রণীত হওয়ার অনুমতি থাকলেও ড্যাপ প্রণয়ন ও গেজেটের আগে আরো কিছু কর্মসম্পাদন ও সেগুলোর অনুমোদিত গেজেট খুব প্রয়োজন। সেগুলো ব্যতিরেকে অর্থাৎ আগের ধাপ যথাযথ ভাবে অনুসরণ না করে পরের ধাপে পা দেয়া বিধিসম্মত হয়না। আমি আসলেই খুব অনিশ্চিত এ বিষয়টি ভেবে যে সরকার কর্তৃক গেজেটকৃত ড্যাপে ইংরেজিতে MASTER PLAN লিখে বাংলায় বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা”লেখাটি কি আসলে বিধিসম্মত, নাকি এখানে খানিকটা গোঁজামিল আছে? মাস্টারপ্ল্যান মানে কি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা?
দুই. প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০২০ উপেক্ষা
২০০০ সালের ৩৬ নং আইনটি পরিবেশ রক্ষার্থে একটি যথাযথ আইন ছিল। ছিল বলার কারণ আইনটি আজ পর্যন্ত বহাল থাকলেও ড্যাপ প্রণেতারা প্রণয়ন এবং গেজেট করাকালে এ আইন অমান্য করেছিলেন। যে আইনের প্রসঙ্গে বলছি সেটি হলো”মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ (২০০০ সালের ৩৬ নং আইন)।
এ আইনের অল্প কয়েকটি ধারা এখানে উল্লেখ করব। ড্যাপ প্রণয়নে এ ধারাগুলোর ব্যত্যয় দেখে সবাই অনুভবে আনতে পারবেন, ড্যাপ পরিবর্তন ও সংশোধনের জন্য এতদিন ধরে যে প্রতিবাদ সবাই (অল্প কয়েকজন বাদে প্রণেতা ও তাদের সমর্থনকারী) করে আসছিলাম তা যথার্থ ছিল।
আইনের ধারা সংজ্ঞা ২ (চ)-এ বলা হয়েছে,”প্রাকৃতিক জলাধার”অর্থ নদী, খাল, বিল, দিঘি, ঝরনা বা জলাধার হিসেবে মাস্টারপ্ল্যানে চিহ্নিত কিংবা সরকার, স্থানীয় সরকার অথবা কোনো সংস্থা কর্তৃক, গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে ঘোষিত কোনো জায়গা এবং সব পানি ও বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোনো ভূমিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
আইনের ধারা ৫ শ্রেণী পরিবর্তনে বাধানিষেধ অংশে বলা হয়েছে,”এ আইনের বিধান অনুযায়ী খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না বা ওইরূপ জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না কিংবা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা অথবা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না!”
আইনের ধারা ৮ (১) শাস্তি, ইত্যাদি অংশে বলা হয়েছে,”কোনো ব্যক্তি এ আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে ণ্ডনীয় হবেন।
এবার আমরা গেজেটকৃত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) বা ড্যাপের কথায় আসি। দেশের প্রচলিত জলাধার সংরক্ষণ আইন মান্য না করে প্রণেতাদের ইচ্ছানুযায়ী প্রাকৃতিক জলাধার দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে—
ক. মুখ্য জলস্রোত এলাকা, খ. সাধারণ জলস্রোত এলাকা
এ ভাগের পরের প্রস্তাবে ড্যাপের বিধি অনুযায়ী সাধারণ জলস্রোত এলাকায় অনেক কিছুই নির্মাণ অনুমোদন যোগ্য! কী কী অনুমোদন সম্ভবপর তা ড্যাপে বিস্তারিত লেখা আছে। যদি মন বলে ড্যাপ খুলে দেখতে পারে এবং তাহলেই অনুভবে নিতে পারবে নদী বা নদীতীরবর্তী নীল বা সবুজ অংশটুকু বালি ভরাটে কেন দ্রুততার সঙ্গে সাদা হচ্ছে। অনুভবে এও নিতে পারবে ড্যাপ আসলে কাদের স্বার্থে প্রণয়ন হয়েছিল।
জলাধার আইন এখনো কার্যকর। এর কোনো ধারা আমার জানামতে এখনো রহিত হয়নি। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার তার শুদ্ধি অভিযানের সময় জলাধার আইন অনুযায়ী কোনো বন্যাপ্রবাহ এলাকা বা জলাধার সংরক্ষণের জন্য যদি চেষ্টা করে আর ড্যাপের সুবিধা ভোগকারী একজন যদি বলেন, ‘ড্যাপের আলোকে আমি নির্মাণের অনুমতি পেয়েছি’ তখন বিচারের ক্ষেত্রে কোন আইন বা বিধি বলবৎ হবে? প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন নাকি ড্যাপ?
যদি জলাধার আইন কার্যকর হয় তাহলে ড্যাপের আলোকে অনুমোদিত ও ভক্ষণকৃত বন্যাপ্রবাহ এলাকা বা জলাধার এলাকায় নির্মিত স্থাপনার ক্ষতিপূরণ কীভাবে হবে ও কে দেবেন? আর ড্যাপের অনুমোদন যদি সঠিক হয় তাহলে জলাধার সংরক্ষণ আইনের কোনো কার্যকরিতা থাকে না; আইন রহিত বা পরিবর্তন করতে হবে। সর্বশেষে একটি প্রশ্ন—যদি জলাধার সংরক্ষণ আইন ঠিক থাকে এবং সেটাই অনুসরণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, তাহলে এ আইন অমান্যের জন্য আইনের ধারা অনুযায়ী শাস্তি ভোগ করবেন কে?
তিন. ড্যাপের নানাবিধ অসংগতি দূরীকরণ
ড্যাপের খসড়া থেকে চূড়ান্ত গেজেট লম্বা একটা সময়। এ পুরো সময়ে ড্যাপ সংশোধনীর বিষয়ে বেশ সরব থাকলেও কোনো আপত্তিতেই কেউ কখনো কর্ণপাত করেননি। বরং অসংগতিপূর্ণ খসড়াটি গেজেট করা হয়েছে। গেজেট হওয়ার পরেও এ বিষয়ে সোচ্চার থাকার পরিপ্রেক্ষিতে এবং তৎকালীন স্থানীয় সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয়কে অসংগতিগুলো ধরিয়ে দিতে পারার ফলে অথবা তিনি নিজেদের ত্রুটি অনুভব করতে পারার পরিপ্রেক্ষিতে গেজেট রিভিউ করে ড্যাপ সংশোধনের জন্য একটি কমিটি করেন! সে কমিটিকে উপেক্ষা করে ১ হাজার ৩৯ পৃষ্ঠার ড্যাপের জন্য মাত্র সাত পৃষ্ঠার একটি সংশোধনী গেজেট করা হয়। সেখানেও অসংগতিগুলো দূর করার পরিবর্তে একটি গোঁজামিল দেয়ার প্রয়াস অব্যাহত থাকে। এ অসংগতিগুলো বা ক্ষেত্রবিশেষে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বেশ সুযোগ করে দেয়ার বিষয়ে কিছু কথা আলোচনায় আনছি!
ড্যাপের প্রাথমিক খসড়া দেখে কেন আপত্তি, কোথায় আপত্তি তা ক্ষেত্র ধরে ধরে লিখিত দিয়েছিলাম। খসড়া চূড়ান্ত করার আগে বহুবার তৎকালীন পিডি মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা কালে উত্থাপিত আপত্তিগুলো তার পক্ষ থেকে নিষ্পত্তি করার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। ড্যাপের গেজেটের আগে চূড়ান্ত খসড়াটি দেখার পরও অসংগতি নিয়ে আপত্তি তুলেছিলাম। রাজউক কর্তৃক একটি হোটেলে আয়োজিত ড্যাপ নিয়ে সর্বশেষ নাগরিক মতবিনিময় সভায় বহুজনকে কথাই বলতে দেয়া হয়নি, বরং ‘ড্যাপ খুব ভালো হয়েছে’ পক্ষের বেশ কিছুজন অনেক কথা বলেছেন। কয়েকজন, যারা কোনোদিন ড্যাপের একটি পাতাও উল্টে দেখেননি তারাও দারুণ ড্যাপ হয়েছে বলেছিলেন। এর মধ্যে কয়েকজন একর একর ভূমির মালিক বলেছিলেন, এটা যুগান্তকারী ড্যাপ। একজন তো বলেছিলেন, আজকেই এটার গেজেট হোক!
দেশের প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনকে মূল্য না দিয়ে, সন্মান না দেখিয়ে মূল জলস্রোতকে মুখ্য আর গৌণ করা হলো। কারণ কয়েকজন ভূমি মালিকের নদীতীরের বন্যাপ্রবাহ এলাকার ভরাট জমি গুগল ম্যাপে নীল বা সবুজ রঙ থেকে বালি ভরাটের জন্য দ্রুতগতিতে সাদা হচ্ছিল, তাদের জমির মালিকানা ও ওই ভূমি ব্যবহারের বিষয়টি দ্রুত হালাল করার প্রয়োজন ছিল!
ড্যাপের যে পাণ্ডুলিপি বিজি প্রেসে মুদ্রণের জন্য পাঠানো হয়েছিল, সেখানে অনেক স্থানে কারো নির্দেশনায় এরিয়া ফার পরিবর্তন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একটি অনুমোদিত খসড়া কীভাবে গোপনে পরিবর্তিত হয়ে প্রিন্ট হয়, কীভাবে এ পরিবর্তন সম্ভব?
তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে গেজেটকৃত ড্যাপের অসংগতি নিয়ে একাধিকবার কথা বলা এবং পৃষ্ঠা ধরে ধরে দেখানোর পর তিনি বিষয়টি বুঝে ড্যাপের তৎকালীন পিডি মহোদয়কে ড্যাপ রিভিউ করার কথা বলেছিলেন। ড্যাপ এ যদি অসংগতি বা ভুল না থাকত, গেজেট হওয়ার পর তা রিভিউ করার নির্দেশনা তৎকালীন মন্ত্রীর বাছ থেকে কখনো আসত না।
রিভিউ করার কমিটি হওয়ার পর সে কমিটি নিয়ে রিভিউ না করে ড্যাপের তৎকালীন পিডি মহোদয় তার একক প্রচেষ্টায় ড্যাপ রিভিউ করলেন। মূল রিভিউ করার জায়গা বাদ দিয়ে সেই বিশেষ ব্যক্তির এলাকানাধীন প্রকল্পের ওয়ার্ডভিত্তিক ক্ষুদ্র এরিয়া ফারকে উচ্চ এরিয়া ফার দেয়ার প্রস্তাব করে পুনরায় সংশোধিত গেজেট হলো।
এ সাত পৃষ্ঠার রিভিউতে যেসব এলাকার এরিয়া ফার ২-এর কম সেখানে দশমিক ৫ প্রণোদনা দেয়া হলো, যেখানে এরিয়া ফার ১ দশমিক ৫-এর কম ছিল তা ১ দশমিক ৫ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ২ হলো। কোনো এলাকার এরিয়া ফার গেজেট হওয়ার পর একক সিদ্ধান্তে যদি এভাবে পরিবর্তন করে বাড়ানো হয়, তাহলে ওই এলাকার এরিয়া ডেনসিটি বাড়বে, যা মূল ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত।
প্রণেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী তাহলে যে ডেনসিটি হিসাব করে এরিয়া ফার নির্ধারণ হয়েছিল সেখানে একটি ফাঁকি আছে। আমার মতে, এ বিষয়ে আদৌ কোনো সার্ভে বা অংক কষা হয়নি, পুরোটাই সম্ভবত কয়েক ব্যক্তির অলৌকিক চিন্তার ফসল।
ব্লক ডেভেলপমেন্টের যা মূল প্রস্তাব ছিল, প্রাথমিকভাবে যে সংশোধন করা হয়েছিল কিংবা পরবর্তী সময়ে যে সংশোধন প্রস্তাব এল, সেখানে আরো অনেক বিশ্লেষণ ও চিন্তার সংশোধন প্রয়োজন, না হলে ব্লক ডেভেলপমেন্টের মতো সুন্দর একটি উদ্যোগ কার্যকরভাবে সুফল আনতে পারবে না।
চার. সংশোধনের অনুরোধ
বহু অসংগতি ড্যাপজুড়ে ঢাকা মহানগরীর সব মানুষের কল্যাণের জন্য, নির্মাণ শিল্পে গতি আনার জন্য গেজেটকৃত ড্যাপ পরিশীলিত হওয়া খুব প্রয়োজন। পেশাজীবী, স্টেকহোল্ডার, অ্যাক্টিভিস্ট প্রতিনিধি মিলে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হোক, তারা পুরো ড্যাপ বিশ্লেষণ করে যেখানে সংশোধন প্রয়োজন তা চিহ্নিত করুক, সংশোধনী প্রস্তাবগুলো একত্র করে দ্রুততার সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করুক। তারপর সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত হোক।
একটি বৈষম্যবিরোধী চিন্তা ও নতুনভাবে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। এ সরকারের সময়ে নির্দিষ্ট কয়েকজনের জন্য গেজেটকৃত বর্তমান ড্যাপ সংশোধন হওয়া উচিত। ঢাকা মহানগরীর সব মানুষের জন্য সময়োপযোগী ও অন্তর্ভুক্তির ড্যাপের নিমিত্ত সবার সুষ্ঠু চিন্তায় একত্রিত হওয়া অবিলম্বে একান্ত প্রয়োজন।
কাজী নাসির: প্রধান স্থপতি (অবসরপ্রাপ্ত), স্থাপত্য অধিদপ্তর, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট।