Thursday, June 1, 2023
বাড়িবাংলাদেশপূর্ব দিগন্তের লাল সূর্যটা

পূর্ব দিগন্তের লাল সূর্যটা

দখল আর বিভক্তি। আমাদের সুদীর্ঘকালের অমানবিক ঐতিহ্যের দুই দুটি শব্দ। আমাদের নিয়তি যা থেকে কোনোদিনও বেরুতে পারেনি। কে জানে- এই ভবে কবেই বা তা হবে?

চারশ’ বছর আগের কথা। একসময় শক্তিমান রাষ্ট্রগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ড দখল করে নিত। দখল করে নিত সেখানকার ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও বিবিধ। ভদ্র ভাষায় বলে Colony বা উপনিবেশ পত্তন। এরপর দখলদারদের ইচ্ছে অনুযায়ী সেখানে তারা শাসন-শোষণ চালিয়ে যেত, যদ্দিন না তাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা সম্ভব হতো। অধিকাংশ সময়ই তা সম্ভবপর হতো না। বর্গীরা শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে জগদ্দল হয়ে চেপে থাকতো বসতি কলুর বলদদের ঘাড়ে।  আর বলাই বাহুল্য, দখলকৃত জনপদের মানুষদের চলতে হতো তাদেরকে প্রভু মেনেই। মূলত ১৬০০’র গোঁড়ার দিকেই বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের বাহানা ধরে ব্রিটিশরা অখণ্ড ভারতবর্ষে প্রবেশ করে বেনিয়ার বেশে। কৌশলে ইংরেজদের নিজেদের মুদ্রার প্রচলনসহ একের পর এক অসামান্য উপকার ও অবিস্মরণীয় উন্নয়নের জোয়ারের সামনে সবাই যখন আবশ্যক বিমুগ্ধ, বিস্তীর্ণ চাটুকারুত্থান, অন্যদিকে বিরুদ্ধমত যখন মিইয়ে গেছে প্রায়, তখন উদীয়মান উন্নতশির প্রতিবাদী যুবক মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজদ্দৌলাকে নাটকীয়ভাবে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করার মাধ্যমে উলটে দেয়া হয় প্রতিবাদের প্রদীপ; ২৩শে জুন ১৭৫৭-তে। স্বাধীনতার সূর্য, বিশেষত বাংলার, অস্তমিত হয়েছিল সেদিনই।

দ্বিতীয় অংকে প্রবেশ করে ক্রাউন শাসনের মেগা সিরিয়াল। একে একে বাংলা, বিহার, ওড়িশা, মহিশুর, মারাঠা, বোম্বাই, মাদ্রাজসহ অধিকৃত হয় গোটা ভারতবর্ষ- পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ। সুযোগে অমেরুদণ্ডী পদলেহনকারীরা পুতুল সরকার তথা ‘আদা বনে শিয়াল বাঘ’ রূপ পরিগ্রহ করে, উল্লেখ্য, যাদের অধিকাংশের ধর্মীয় পরিচয় মুসলিম ধর্মের বাইরে। সেই থেকেই ব্রিটিশ রাজ তাদের শক্তিবলে শাসন করে আসছিল দক্ষিণ এশিয়ার ব্রিটিশ ভারত নামের আমাদের এই সুবিস্তৃত জনপদ। আমাদের বলতে- এখনকার ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের এই সবুজ, শস্যপূর্ণ অঞ্চল। নিজেদের প্রয়োজনে বা স্বেচ্ছাচারিতার কারণে প্রভুরা বহুবার বিচিত্র ও বিভিন্নভাবে এই অঞ্চলগুলোকে ভাগ করে ফেলত; খানিকটা পুতুল পুতুল খেলার মতোই। বিস্তীর্ণ অধিকৃত অঞ্চল ও বিপুল ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ব্রিটিশরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ও কর্মঅঞ্চলকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে সংখ্যাগুরু ও রাজদণ্ড পরিবেষ্টনকারী শিক্ষিত হিন্দু সমাজ তখন ভিনধর্মমুক্ত আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এই স্বপ্নের খড়কুটোতে অগ্নি ও ঘৃতের জোগান দিলো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি গানের শিরোনাম ‘বন্দেমাতরম্‌’, যা একাধারে বঙ্গজননি, ভারতমাতা ও দেবী কালীর উদ্দেশ্যে রচিত এবং পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলন ও রায়টে  ‘বন্দেমাতরম্‌’ শ্লোগান স্বীকৃত হলো জাতীয়ভাবে। অপরদিকে ‘ঈমান বাঁচানোর তাগিদে’ রাজদণ্ড থেকে বহুদূরে অবস্থানকৃত মুসলমান সমাজেও একই স্বপ্ন বড় হতে থাকলো স্বকীয়তায় ও প্রতিহিংসায়- সজোরে আযান হাঁকিয়ে মসজিদে জমায়েত হবে, আতর-লোবানে খোশবু বিলাবে হামদের মাহফিলে, আর খোদার রাহে গরু কোরবানি করে তেজালি নুসরত কামাই করবে ইব্রাহিম নবীর পেয়ারা অনুসারীগণ। শুধু তাই নয়, ঈমান ভস্মি হওয়া থেকে রক্ষা পেতে মুসলমান নেতারা শ্বেতবর্ণ নাছারাদের ভাষা ইংরেজি শেখাকেও হারাম করে দিল। এরই পথ ধরে নিয়মিত প্রতিহিংসা, দাঙ্গা, রক্তগঙ্গা, জেল-জুলুম, অসহযোগ ও সাম্প্রদায়িক লোমহর্ষক কাহিনী দিনে দিনে ঠাই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের আরও অনেক পাতা উলটে ১৯৪৭-এ এসে জন্ম নিতে হলো আলাদা আলাদা রাষ্ট্রের – ভারত ও পাকিস্তান। বাংলাদেশের ভূখণ্ড তখন পাকিস্তানের অংশ। পূর্ব-পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা নামে পরিচিত। ‘মুসলমান ভাই ভাই’ এই বিশ্বাস মনে প্রাণে মেনে অবশেষে পূর্ব বাংলার মানুষেরা নিজস্ব পরিচয়ে প্রশান্ত, ভেবেছিল ‘মানযিল মিল গায়া’। ঠিক তখনই, পাকিস্তান জন্মের মাস সাতেক পরে, ১৯৪৮-এর মার্চে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ তার জীবনের প্রথম ও শেষবারের মত পূর্ববঙ্গ সফরে এসেছিলেন। তিনি হয়তো ভাবেন নি যে সেখানে তার উচ্চারিত কিছু কথা একসময় বেমাক্কা বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে, তারই প্রতিষ্ঠিত নুতন দেশটির ভাঙন ডেকে আনতে। জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লিগেরও সভাপতি। নয় দিনের সফরে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি সভায় বক্তৃতা দেন। ঢাকায় প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ, রেসকোর্স ময়দানে- হালে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান।এতে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু – অন্য কোন ভাষা নয়। ইংরেজিতে দেয়া সেই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ” উর্দু ছাড়া অন্য কোন ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।”

তার সফরের আগেই পূর্ববঙ্গে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে তদ্দিনে।পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই দেখা গেল- নতুন দেশের ডাকটিকিট, মুদ্রা, মানি-অর্ডার বা টাকা পাঠানোর ফর্ম, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড- সবকিছুতেই উর্দু আর ইংরেজি, বাংলা নেই। সামরিক বাহিনী ও সরকারি চাকরিতেও অবাঙালিদের প্রাধান্য। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নৌবাহিনীতে লোক নিয়োগের পরীক্ষাও হচ্ছে উর্দু ও ইংরেজিতে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সমস্ত ক্ষেত্রে দেশের অন্য একটি অংশের নাগরিকদের প্রতি পদে পদে বৈষম্য।

কয়েকদিন পর জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে কার্জন হলে আরো একটি ভাষণ দিলেন। সেখানেও একই কথা বললেন। বললেন, পাকিস্তানের প্রদেশগুলো নিজেদের সরকারি কাজে যে কোন ভাষা ব্যবহার করতে পারে – তবে রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে একটিই এবং তা হবে উর্দু। অনুষ্ঠানে জিন্নাহর বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে কার্জন হলে উপস্থিত ছাত্রদের একটি অংশ তখনই ‘নো-নো’ বলে প্রতিবাদ করে ওঠে। ভাষণ শেষে- সেদিনই বিকেলে তার সাথে দেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি দল । এ সময় ভাষা নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক প্রায় ঝগড়াঝাটির স্তরে পৌঁছে যায়। উল্লেখ্য, এই ছাত্র নেতারা অনেকেই ছিলেন জিন্নাহর দল মুসলিম লিগের। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে কেউই দলীয় পরিচয়ের এপ্রোন গায়ে তোলেনি। মজার ব্যাপার হল পূর্বাংশে গোটা ভাষাই ছিল বাংলা, পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ শতাংশের কিছু বেশি লোকের ভাষা ছিল পাঞ্জাবী, আর মাত্র চার শতাংশের ভাষা ছিল উর্দু।

ঐতিহাসিকভাবেই বাংলার মানুষেরা যেমন অতিথিপরায়ণ, সরলপ্রাণ, যেমন আবেগপ্রবণ, আবার যেমন ইতিহাস বিস্মৃত, বিত্তহীন,অলস ও অনুন্নত জীবন যাপনে অভ্যস্ত, যেমন অশিক্ষা-কুশিক্ষা জর্জরিত, ঠিক তেমনি আবার প্রতিবাদমুখর, অন্যায়-বিরুদ্ধ, তেমনি সোচ্চার অনাচারে, অধিকার ছিনতে দূর্বার, দুর্বিনীত ও দুঃসাহসী। জুলুমের বিরুদ্ধে জীবনকে তুচ্ছ কচু পাতার পানি ভাবতে বাঙ্গালীর সমকক্ষ আর কে আছে? তাই, পাকিস্তান জন্মলগ্নেই মি. জিন্নাহর এই দাম্ভিক উক্তি মূলত পূর্ব বাংলার আপামর জনসাধারণের রক্তে প্রতিবাদ, ঘৃণা ও বিদ্রোহের বীজ বপন করে গিয়েছিল। বাসরের সানাইয়ের সাথে বিচ্ছেদের বিউগল যেন এক লহরীতে বেজে উঠেছিল। চিরবঞ্চিত পূর্ব বাংলার জনগণ আবারও নিজেদেরকে শেকড়হীন বা দুই নম্বর মুসলমান বলে জানতে করতে শুরু করল।

‘৪৮-এ জিন্নাহর মৃত্যুর পর নবনিযুক্ত গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিনও উর্দুর পক্ষে আরও শক্ত  অবস্থানে গেলে আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা বাংলায়- টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। ছাত্র, কবি, শিল্পী, অধ্যাপক, নেতা, দিনমজুর, পথচারী- সর্বস্তরের মানুষ নেমে এসেছিল রাজপথে, মায়ের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে দেবে না বলে।

ভাষা সৈনিক শিল্পী আবদুল লতিফের সেই কালজয়ী গান জাগালো আপামর জনসাধারণকে-

 ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে,

কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়
এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়’

 অতুল প্রসাদ সেনের

‘মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা’

 

একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবন এলাকায় পুলিশ। ছবি: মোহাম্মদ তকীউল্লাহ (সূত্র: বদরুদ্দিন উমরের গ্রন্থ ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’)

 

২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হলে তা প্রতিহত করতে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্রজনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিবর্ষণে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ এবং আব্দুল জব্বার, আর হাসপাতালে আব্দুস সালাম।সরকারি হিসাব মতে এ সংখ্যা ৪ হলেও বাস্তবে তা কতগুণ তা কেউ জানে না। তবে মাতৃভাষার দাবীতে পৃথিবীতে এর আগে আর কখনও কাউকে জীবন দিতে হয়নি। তাই ২১শে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি যেমন বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মানের, পাকিস্তানের জন্য তেমন তীব্র ঘৃণার।

ভাষা শহীদদের নিয়ে লেখা আবদুল গাফফার চৌধুরীর কালজয়ী গান

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’,

-যেন বিশ্ব বিবেকের কাছে আজীবন বিচারের আর্জি হয়েই বাজে।

২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২’র সকাল 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি তুলে সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে তমদ্দুন তাদের পুস্তিকা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু? প্রকাশ করে এবং তাতে বাংলা ভাষাকে পূর্ব বাংলায় ভাব বিনিময়, অফিস ও আদালতের একমাত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করে। বাংলা ভাষা আন্দোলনের জনপ্রিয় মুখপত্র হিসেবে ১৯৪৮-১৯৬১ সাল পর্যন্ত তমদ্দুনের পত্রিকা সাপ্তাহিক সৈনিক নামে কথাশিল্পী শাহেদ আলীর সম্পাদনায় প্রকাশ করে।

শেষমেশ দুঃখ ও আনন্দের মিশ্র তথ্য হল এই যে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে প্রথম আপত্তি করা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর (১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮) পর করাচিতে তার সমাধির স্মৃতিফলকে (Epitaph) বাংলাতেই লেখা হয়েছে তার জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ।

পাকিস্তানের জন্মের পর প্রথম এক দশক ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কেউ কেউ মনে করেছিলেন, পাকিস্তান ভেঙে গিয়ে এক সময়ে যে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম হবে দেশটির সূচনালগ্নেই তার ছিটেফোঁটা আভাস রয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ট্রিনিটি এরকমই- আল্লাহ, আর্মি, আমেরিকা-ইন্ডিয়ার চক্করে যার রুচি নেই। এই কথিত সুবিধাবাদী বায়াত তারা বাংলায় রপ্তানি করতে পারেনি, যার ফলে উন্নত মুসলমান হিসেবে পাকিস্তান সরকার বাংলার নেড়ে মুসলমানদের ওপর ক্রমশ অসহিস্নু ও অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছিল।

একই দেশের দুটো অংশের মধ্যে চরম বৈষম্য ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। রাজনৈতিক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘আওয়ামী লীগ: উত্থান পর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বইয়ে লিখেছেন: “বাঙালি মুসলমান পরিচিত প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে এক রাষ্ট্রে বসবাস করবে না, এই লক্ষ্য নিয়ে অপরিচিত দূরবর্তী অঞ্চলের মুসলমানদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকিস্তান বানাল। তবে মোহভঙ্গ হতে দেরি হলো না।”

বছরের পর বছর ক্রমাগত বৈষম্যের ব্যবধান আকাশ-পাতাল হতে লাগলে, ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ছয় দফাঃ আমাদের বাঁচার দাবি পেশ করেন।সরকারের পক্ষ থেকে মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে ছয় দফা’কে নাকচ করে দিলে শুরু হয় তীব্র গণআন্দোলন।

পুলিশের গুলিতে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ মৃত্যুবরণ করেন। সহযোদ্ধারা আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মিছিল করে। পরে শেরে বাংলা নগর ও মোহাম্মদপুরের সংযোগ স্থলে আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে আসাদগেট নামকরণ করা হয়।

তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ১৯৭০-এ। 

অবস্থা বুঝে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে কারফিউ দিয়ে দিলেন। কারফিউ ভেঙে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে তৎকালীন ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব ও ডাকসু নেতারা উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা।

এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। রেসকোর্স ময়দানে ১৮ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণাই দিয়ে দিলেন।

আপনজনদের মায়া দুহাতে সরিয়ে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নয় মাসের জীবনপণ যুদ্ধে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১এর ১৬ ডিসেম্বরে পৌষের প্রথম সূর্যকে বয়ে আনতে যে ত্যাগ ও সাহসিকতা সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছিল তা ছিল কালের ইতিহাসে নজিরবিহীন। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এই অযুত সম্ভাবনার ছোট্ট দেশটির বীরত্বগাঁথাই প্রমাণ করে যে, দেশপ্রেমি সঠিক নেতৃত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জোরেই আমরা দুর্নীতিমুক্ত উন্নত আবাস গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। তাই, বিজয়ের শপথ হোক- বৈষম্য আর বিভক্তির সীমানা ডিঙিয়ে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে এ জনপদকে

‘শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’।

 

কারণ-

অনেক বিজয় এসেছে আবার
অনেক বিজয় আসেনি যে
অনেক বিহান হেসেছে আবার
অনেক বিহান হাসেনি যে!

পেরিয়ে এসেছি অনেক অনেক পথ
ছিঁড়েছি অনেক গোলামীর দাসখত্
ভেঙেছি অনেক লৌহকপাট-কারা
অনেক ঝরেছে তপ্ত-রক্ত-ধারা
অনেক হয়েছে মহাজীবনের ক্ষয়
অনেক হয়েছে বেদনার সঞ্চয়
তবুও পূর্ণ জয়ের সূর্য
এখনো আকাশে ভাসেনি যে;
অনেক বিজয় এসেছে আবার
অনেক বিজয় আসেনি যে!’

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
সম্পর্কিত প্রবন্ধঃ

মন্তব্য বাদ দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন

সবচেয়ে জনপ্রিয়