মানবতার মুক্তিদূত রাসুল (সাঃ) ছিলেন মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাষ্যকার এবং তাঁর জীবদ্দশায় এই কুরআনকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এর ব্যতিক্রম নয়। তাঁর স্বাস্থ্যনীতির রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আমরা জানি যে, রোগ প্রতিরোধ রোগের চিকিৎসার চেয়ে অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী।
খাদ্যাভ্যাসঃ রাসুল (সাঃ) পাকস্থলীর তিন ভাগের এক ভাগ খাবার দিয়ে পূর্ণ করতে বলেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত কম আহার করলে হৃদরোগ সহ বেশ কিছু রোগ কম হয়ে থাকে। তিনি আরও বলেন যে, আদম সন্তানের জীবন ধারনের জন্য কয়েক লোকমা খাবারই যথেষ্ট। রাসুল(সাঃ) সব ধরণের খাবারই খেতেন। কোন কোন ধর্মীয় সম্প্রদায় আমিষ জাতীয় খাবার পরিহার করেন। তাতে আমিষ ও কিছু ভিটামিনের অভাবে বেশ কিছু রোগ হতে পারে।
শারীরিক পরিশ্রমঃ শারীরিক পরিশ্রম বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ও সুস্থ থাকার জন্য অন্যতম নিয়ামক। রাসুল (সাঃ) শারীরিক পরিশ্রমের উৎকৃষ্ট নজীর স্থাপন করেছেন। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও নিজের হাতে মাটি কেটেছেন, পাথর বহন করেছেন, উটের দড়ি টেনেছেন, কবর খনন করেছেন, ঘর ঝাড়ু দিয়েছেন, জুতা সেলাই করেছেন। তিনি পায়ে হেঁটে রোগী দেখতে যেতেন। তিনি মানুষকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে হেঁটে মসজিদে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন, মৃতের লাশ বহনে উৎসাহিত করতেন। তাছাড়া হজ্জ,ওমরা, তারাবীহ ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেও রয়েছে শারীরিক পরিশ্রম। রাসুল (সাঃ) এর পরিশ্রম ছিল Productive অর্থাৎ তাঁর পরিশ্রম ছিল কোন কর্ম সম্পাদনের জন্য, শুধু শারীরিক পরিশ্রম নয়।
রোজাঃ এটি রোগ প্রতিরোধের অন্যতম একটি মাধ্যম। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) রমজানের পাশাপাশি সারা বছর ব্যাপী সাপ্তাহিক,আইয়ামে বীজের রোজা,মুহররম ও আরাফাতের রোজা ইত্যাদি রোজা রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। এতে শরীরের দুর্বল কোষগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় (Autophagy)। এই আবিস্কারের জন্য একজন জাপানী বিজ্ঞানী নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকার অনেক ডাক্তার উপবাস বা রোজার মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যাপারে রোগীদের উৎসাহিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রে মরমন খৃস্টান সম্প্রদায় রয়েছে যারা আট বছর বয়স থেকে নিয়মিত রোজা রাখেন। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, তাদের মধ্যে হৃদরোগ ঐ দেশের সাধারণ মানুষের চেয়ে কম।
পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতাঃ আগে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না। যেমন, ব্রিটিশ রাজা জেমস ১ তার জীবনে কখনো গোসল করেননি, ফরাসী রাজা চতুর্দশ লুই ও স্পেনের রানী ইসাবেলা জীবনে মাত্র দুই বার গোসল করেছেন। রাসুল (সাঃ) পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে ধর্মীয় অনুশাসনের অংশ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ইমান থেকে। তিনি আমাদেরকে উৎসাহিত করেছেন যেন আমরা খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুই, দৈনিক পাঁচবার নামাজের জন্য,কুরআন পড়ার জন্য, এমনকি রাগের সময় ওযু করি। সারাক্ষণ ওযু অবস্থায় থাকার মধ্যে রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। তাছাড়া রয়েছে জুময়ার দিনে গোসল ও ফরজ গোসল। এভাবে বেশকিছু সংক্রামক, চর্মরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। সম্প্রতি করোনা মহামারীতে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ঘন ঘন হাত ধোয়ার উপদেশ যেন রাসুল (সাঃ) এর সুন্নাহরই বাস্তবায়ন।
মহামারী ও সংক্রামক রোগঃ রাসুল (সাঃ) বলেন যে, যখন কোথাও মহামারী দেখা দেয় তখন কেউ যেন ঐ এলাকায় না যায় এবং ওখান থেকেও যেন কেউ বাইরে না যায়। আধুনিক চিকিৎসায় কোয়ারেন্টাইন হচ্ছে রাসুল (সাঃ) এর ঐ মূলনীতির বাস্তবায়ন। এর মাধ্যমে মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
মাদকাসক্তিঃ কোরআন ও হাদিসে মদ ও নেশা জাতীয় বস্তুকে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাসুল (সাঃ) বলেন, সর্বপ্রকার নেশা জাতীয় পানীয় হারাম (বুখারি)। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৯৫০০০ এর বেশি মানুষ মদজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে থাকে। ভারতে এই রোগে ২০-৩০% লোক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকে। অথচ এই রোগগুলো সহজেই প্রতিরোধযোগ্য।
ধূমপানঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ফুসফুসের ক্যান্সার ছিল বিরল। বর্তমানে প্রতিবছর পৃথিবীতে ১৮ লক্ষ লোক ফুস্ফুসের ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে থাকে যার ৯০ % কারণ হচ্ছে ধূমপান। হৃদরোগের ২৫% কারণও হচ্ছে ধূমপান। ২০২০ সালে শুধু সিগারেটের কারণে পৃথিবীতে মৃত্যুবরণ করেছে ৮০ লক্ষ লোক। মহান আল্লাহ বলেন,
“তোমরা নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংসে নিক্ষেপ করোনা”। (কুরআন ২:১৯৫)
“আর তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করোনা।” (কুরআন ৪:২৯)
ধূমপানের কারণে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা ধীরে ধীরে আত্মহত্যার নামান্তর। রাসুল (সাঃ) আত্মহত্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
পান সুপারিঃ এটি নেশা উৎপাদনকারী বস্তু। ভারতীয় উপমহাদেশে সুপারীর দ্বারা মুখের ও খাদ্যনালীর প্রচুর ক্যান্সার (৩৫% ক্যান্সার) হয়ে থাকে। তাছাড়া উচ্চরক্তচাপ ,ডায়েবেটিস, হাপানি বৃদ্ধি পাওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি অঙ্গকে সুপারী ক্ষতি করতে পারে। চুনের কারণে হাইপারক্যালসেমিয়া, কিডনি ইনজুরি এবং কিডনিতে পাথর হতে পারে। আর জর্দা ও গুলের ক্ষতি সিগারেটের চেয়ে ৩-৪ গুন বেশি। অস্ট্রেলিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সুপারীর ব্যাবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, রাসুল (সাঃ) নেশা উৎপাদনকারী সব বস্তু হারাম বলেছেন।
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাঃ রাসুল (সাঃ) বলেছেন যে, “দুটি নিয়ামতের ব্যাপারে অনেক মানুষ আত্মপ্রতারণার নিমজ্জিতঃ স্বাস্থ্য ও সময়” (বুখারী)। তিনি আরও বলেছেন যে, “তোমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রার্থনা কর, কারণ ঈমানের পর সুস্বাস্থ্যের চেয়ে বড় কোন নিয়ামত আর কিছু নেই”। (তিরমিযি, নাসাঈ) চিকিৎসার ব্যাপারে রাসুল (সাঃ) এর সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন যে, “আল্লাহ এমন রোগ সৃষ্টি করেননি যার চিকিসার ব্যাবস্থা করেন নি”। এই হাদিসটি ডাক্তার ও রোগীর মনে অনেক আশা সঞ্চার করে। একজন বেদুঈন রাসুল(সাঃ) এর কাছে জানতে চাইলেন যে, অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিবে নাকি তকদীরের উপর ভরসা করে বসে থাকবে। তিনি তাকে চিকিৎসা নিতে বলেন। রাসুল (সাঃ) বলেছেন যে, কোনো ব্যাক্তি চিকিৎসা সম্পর্কে না জেনে যদি চিকিৎসা করে তবে সে দায়ী হবে (ভুল চিকিৎসার জন্য)। (আবু দাউদ, দিয়াত অধ্যায়)। আমাদের সমাজে অনেক স্বঘোষিত ডাক্তার আছে যারা প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়া দোকান, চেম্বার খুলে বা রাস্তা-ঘাটে অপচিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য রাসুলের হাদিসটি একটি সতর্কবাণী। একবার দুজন ডাক্তার এলো চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। রাসুল (সাঃ) জানতে চাইলেন তাদের মধ্যে ভাল কে? অর্থাৎ রোগীদের উচিত সঠিক ডাক্তার নির্বাচনের ব্যাপারেও গুরুত্ব দেয়া।
মানসিক সুস্থতাঃ
যুক্তরাষ্ট্রে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বহির্বিভাগে যেসব রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন তাদের ৭০% রোগীর শারীরিক কোন রোগ নেই। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত অনেক রোগী বা মানসিক অশান্তির কারণে অনেকে আত্মহত্যা করে বসে। জাপানে শুধু ২০১৭ সালে আত্মহত্যা করেছে ২১৩২১ জন। রাসুল (সাঃ) বলেন যে, “যেকোনো মুসলিমের উপর কোন কষ্ট বা রোগ ব্যাধি হলে আল্লাহ তার গুনাহগুলো ঝড়িয়ে দেন, যেমনভাবে গাছ তার পাতাগুলোকে ঝড়িয়ে দেয়”।(বুখারী, কিতাবুত তিব)
তিনি আরও বলেন, “তোমাদের কেউ দুঃখে কষ্টে পতিত হবার কারণে যেন মৃত্যু কামনা না করে। যদি কিছু করতেই হয় তাহলে সে যেন বলে, ‘হে আল্লাহ আমাকে জীবিত রাখ, যতদিন আমার জন্য বেঁচে থাকা কল্যাণকর হয় এবং আমাকে মৃত্যু দাও, যখন আমার মরে যাওয়া কল্যাণকর হয়।” (বুখারি, কিতাবুত তিব)
রাসুল (সাঃ) বলেন, “কোথাও যদি প্লেগ মহামারী ছড়িয়ে পরে এবং তথাকার এ বান্দা এ কথা জেনে বুঝেই ধৈর্য সহকারে শহর/বাড়িতে অবস্থান করে যে, আল্লাহ তায়ালা তার ভাগ্যে যা লিখে দিয়েছেন সেই বিপদ ছাড়া আর কিছুই তার উপর আসবেনা, তবে সে শহীদের অনুরূপ সওয়াব পাবে”। (বুখারী,কুতাবুত তিব)
রাসুল (সাঃ) এই বাণীগুলো মহামারীর আতংকের সময় আমাদের মনে প্রশান্তি এনে দেয়।
অহংকার রাগ গালমন্দঃ রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবেনা”। (মুসলিম)
রোগী বা ডাক্তারের মধ্যে অহংকার,ক্রোধ ইত্যাদি থাকলে চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “কুস্তিতে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে জয়লাভ করাতে বীরত্ব নেই। ক্রোধ ও গোস্বার মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করতে পারাই প্রকৃত বীরত্বের পরিচয়।“ (বুখারী)। ক্রোধের কারণে কোন কোন রোগ গুরুত্বর আকার ধারণ করতে পারে যেমন- স্ট্রোক,হার্ট এট্যাক ইত্যাদি।
হাস্য–কৌতুকঃ রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “তোমার ভাইকে হাসি উপহার দেওয়াও একটি সাদাকা । তিনি মাঝে মাঝে হাসি-কৌতুক করতেন। রোগীকে হাসি মুখে বরণ করলে তা তার জন্য মানসিক প্রশান্তির কারণ হয়”।
দাওয়াই ও দোয়াঃ চিকিৎসার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে রোগ মুক্তির জন্য সাহায্য চাওয়া এবং তাঁর উপর সার্বিক নির্ভরশীলতা রোগীর মনে প্রশান্তি এনে দেয় এবং হতাশা দূর করে। একটি গবেষণা হয়েছে যেখানে এক গ্রুপ রোগী জানতো যে, তাদের জন্য প্রার্থনা করা হচ্ছে। অন্য গ্রুপের জন্য কেউ প্রার্থনা করেনি। তাতে চিকিৎসায় প্রথম গ্রুপের উপর উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া গেছে ।
সামাজিক স্বাস্থ্য ও কল্যাণঃ
গবেষণায় দেখা গেছে যে, সমাজে বিত্তবানদের চেয়ে দরিদ্রদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশী। কারণ চিকিৎসার ব্যয় বহনে অপারগতা। রাসুল (সাঃ ) দারিদ্র্য দূরীকরণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। জুয়া, লটারি , চুরি, ডাকাতি কঠোর হস্তে দমন করেছেন সুদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আর যাকাতকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দান সাদাকাহকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, সুস্থ অবস্থায় সাদাকাহ করো, যখন তোমার ধনী হওয়ার বাসনা ও গরীব হওয়ার আশংকা থাকবে এবং এত দেরী করোনা যে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। ইসলামের স্বর্ণযুগে দান সাদাকাহ ও ওয়াকফ করা সম্পত্তির মাধ্যমে হাসপাতাল ও চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
মানুষ হত্যা, আত্মহত্যা ও ভ্রূণহত্যাঃ মহান আল্লাহ ও তার রাসুল এগুলোকে কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ করেছেন।
বৈরাগ্যবাদ , চিরকুমারিত্বঃ এগুলো সুস্থ মন ও দেহের জন্য হুমকি স্বরূপ। কোন কোন ধর্মে চিরকুমার কুমারী থাকাকে আধ্যাত্মিকতার নিদর্শন মনে করা হয়। রাসুল (সাঃ) এ ধারণা দূর করে দেন। তিনি বলেন, তোমাদের দুনিয়া থেকে স্ত্রী লোক ও সুগন্ধি আমার কাছে প্রিয় করা হয়েছে। আর নামাজ হচ্ছে আমার চক্ষু শিতলকারী।
বিয়ে ও বিবাহ বিচ্ছেদ , অবৈধ যৌনাচারঃ বিয়ের মধ্যে মহান আল্লাহ তা’য়ালা অনেক শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণ নিহিত রেখেছেন। রাসুল (সাঃ) বলেন, “হে যুবসমাজ তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা বিয়ে দৃষ্টিকে নিচু করে রাখে এবং যৌন জীবনকে সংযমী করে ,আর যে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখেনা সে যেন রোজা পালন করে কেননা রোজা তাঁর যৌন কামনা কমিয়ে দেয়।“ ( বুখারী )
পরকীয়া প্রেম, অবৈধ যৌনাচার সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং এইডস, সিফিলিস , গনোরিয়া ইত্যাদি যৌন রোগের কারণ। এইডস আফ্রিকার অনেক দেশে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।বিবাহ বিচ্ছেদ শারীরিক , মানসিক ও সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে। রাসুল সাঃ বলেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত হালাল হচ্ছে তালাক । বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ৫০%। এর ফলে সন্তানদের মধ্যে মানসিক সমস্যা ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
ভেজাল খাবার ও ধোঁকা দেওয়াঃ রাসুল (সাঃ) খাবার বা কোন পণ্যের দোষ ত্রুটি থাকলে তা ক্রেতাকে অবহিত করতে বলেছেন । অথচ আমাদের দেশে ভেজাল খাবার ও নিম্ন মানের ঔষধের সয়লাবে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন , “যে ব্যক্তি আমাদের উপর অস্ত্র উত্তোলন করে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যে আমাদের ধোঁকা দেয়, সেও আমাদের লোক নয়।” (মুসলিম)
পরিবেশ সংরক্ষণ ,বৃক্ষ নিধন ও রোপণঃ স্বাস্থ্য রক্ষায় স্বাস্থ্যকর পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসুল (সাঃ) বলেনঃ “তোমাদের কেউ যেন বদ্ধ পানিতে প্রসাব না করে এবং পরে সেই পানিতে গোসল না করে। “তিনি কাটা বা অপ্রিয় জিনিষ মানুষের চলার পথ থেকে সরানোকে ঈমানের একটি অংশ সাব্যস্ত করেছেন। যুদ্ধের সময়ও ফলবান বৃক্ষ কাটতে তিনি বারণ করেছেন। তিনি বলেন , “কোন মুসলিম কোন বৃক্ষরোপণ করলে , সে বৃক্ষের ফল থেকে যদি মানুষ ও জীব-জন্তু খায় তাহলে তা তার জন্য সাদাকা হয়ে যাবে”।
এই হচ্ছে রাসুল (সাঃ) এর স্বাস্থ্যনীতি। রাসুল (সাঃ) রাষ্ট্রপ্রধানও ছিলেন । একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করে থাকেন,চিকিৎসা প্রদান করেনা। তাঁর স্বাস্থ্যনীতি শুধু তাত্ত্বিক বা ওয়াজ নসীহতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং তা সমাজে তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন। একজন অমুসলিম ডাক্তার (হারিস বিন কালাদা) মদিনায় চিকিৎসা করতে এলেন। বেশ কিছুদিন মদিনায় অবস্থান করার পর কোন রোগী পাওয়া গেল না। কারণ জানতে চাইলে রাসুল (সাঃ) বললেন যে, “আমরা ক্ষুধার্থ হলে খাবার খাই এবং ক্ষুধার্থ অবস্থায় খাওয়া বন্ধ করি”।
কালোজিরা, রক্তমোক্ষণ ইত্যাদিঃ
বুখারী শরিফে “কিতাবুত তিব” অধ্যায়ে রাসুল (সাঃ) এর চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশ কিছু হাদিস আছে যা আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। যেমন, কালোজিরা, রক্তমোক্ষণ, চন্দনকাঠ, আগুন দিয়ে দাগ লাগানো, উটের প্রসাব দিয়ে চিকিৎসা ইত্যাদি। এ ব্যাপারে রাসুল (সাঃ) এর খেজুর গাছের পরাগায়ন সংক্রান্ত হাদিসটি গুরুত্বপূর্ণ। মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সাঃ) এর পরামর্শে আনসাররা খেজুর গাছের পরাগায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। তাতে খেজুর ফলনে মন্দভাব দেখা দেয়। তখন রাসুল (সাঃ) বল্লেন যে, “দ্বীনের ব্যাপারে আমি যদি কিছু বলি তা মেনে নাও, আর দুনিয়ার ব্যাপারে আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ(অর্থাৎ আমারও ভুল ভ্রান্তি হতে পারে) ”। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামি চিন্তাবিদ ডঃ ইউসুফ আল কারযাভির অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি কোরআনের একটি আয়াতকে উপমা হিসেবে পেশ করেন যেখানে বলা হয়েছে যে, সদাসজ্জিত ঘোড়া শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত করে রাখো যেন তাদের ভীত শঙ্কিত করতে পার।(কুরআন, ৮:৬০) এখানে স্থায়ী উদ্দেশ্য হচ্ছে শত্রুকে প্রতিহত করা আর অস্থায়ী উপরকরন হচ্ছে ঘোড়া যার স্থান দখল করেছে বর্তমানে ট্যাংক, কামান ইত্যাদি। তিনি বলেন, “সুন্নাহকে বুঝতে সন্দেহ ও ভুলের যেসব কারন ঘটে তা হচ্ছে এই যে, কিছু লোক স্থায়ী উদ্দেশ্য ও অস্থায়ী উপকরণগুলোকে (যেমন কালোজিরা , আজওয়া খেজুর ইত্যাদি) গুলিয়ে ফেলেন”। আমি মনে করি এসব ব্যবস্থাপত্র রাসুল (সাঃ)প্রদত্ত ঔষধের মর্ম নয়। বরং এর মর্ম হচ্ছে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পীড়িত হলে চিকিৎসা। এর মর্ম এই যে,চিকিৎসা নেয়া তকদীরে বিশ্বাসের পরিপন্থী নয়,না আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ভরশীলতার বিপরীত। এর অর্থ হচ্ছে,প্রত্যেক রোগের চিকিৎসা আছে যা নেয়া সুন্নাত। উপায় ও উপকরণ সময়ে পাল্টায়(যেমন রক্তমোক্ষণ ও কালোজিরার স্থান নিয়েছে আধুনিক চিকিৎসা) কিন্তু উদ্দেশ্য একই রয়ে গেছে। “( সুন্নাহের সান্নিধ্যে, ডঃ ইউসুফ আল কারযাভি)
লেখকঃ প্রফেসর কর্নেল ডাঃ জেহাদ খান (অবঃ)
মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ