ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। সকাল আটটা ত্রিশে ক্লাস। তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হই। খাওয়ার সময়টা পর্যন্ত নেই। বই খাতা যা লাগে গুছানো ছিল। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এসে দেখি ঝুমবৃষ্টি। দারোয়ান মামা বললেন, টাপুরটুপুর হচ্ছেতো হচ্ছেই থামার নাম গন্ধ নেই। এ যেন শরতের দিনে বর্ষার অনুভূতি। এ মুহুর্তে রিকশা শেষ ভরসা। চোখ মেলে দৃষ্টি যতদূর যায় আশপাশে একটা রিকশাও দেখা যায় না। ক্লাসে যেতেই হবে। বের হলাম বাসার গেট থেকে। প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে কি আর করার! আরেকটু গেলে বাঁকের পরে রিকশা মিলবে এ আশায়। ভাগ্যভাল। রিকশায় চেপে বসি। আহা! মামাটা যে ভিজে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করি রেইনকোট আছে কি? আবার মনে মনে ভাবলাম কষ্ট দিয়ে ফেললাম না তো? ঠোঁটকাটার মত পুনরায় বলি আপনারতো জ্বর হবে। বললেন আমগো কিচ্ছুই হইবো না মামা। আপনাগো বইয়া যা পাই তা এই পেটে পড়লে সব ঠিকঠাক। আমার ছাতাটা এগিয়ে দিলাম। কিন্তু যে বাতাস আর রিকশার গতিবিধি অনুযায়ী ছাতা ধরে রাখা টাপ; ছিটানি আসে। চেষ্টার কমতি রাখলাম না। ভালই লাগছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে ভার্সিটির কাছাকাছি পৌঁছে যায়। নেমে প্রশান্তির দিক থেকে প্রাপ্যর চেয়ে আঁধটু বাড়িয়ে দিলাম। মামা এই বৃষ্টিভেজা সকালে ফুরফুরে মেজাজে এক অমায়িক হাসি দিয়ে হ্যান্ডেল ঘোরালেন। আমিও চলে গেলাম ক্লাসে। প্রায় চার পিরিয়ড শেষে বের হলাম। আজকাল ইউনিভার্সিটিতে মন টিকে না। বড় হয়ে গেছি হয়তো। সেই ফাস্ট সেমিস্টারের মত ফিল আর হয় না। তাইতো ক্লাস শেষ মানে ভার্সিটি থেকে কখন মেসে যাব মনটা আনচান করতে থাকে। ঠিক দ্রুতই দশম ফ্লোর থেকে লিফট বেয়ে নিচে আসি। গেটে দেখি একজন অচেনা মায়ের বয়সী মহিলা সাদা প্লাকার্ড হাতে দাড়িয়ে আছেন। বোঝায় যাচ্ছে লেখাগুলো হাতের প্রিন্ট নয়। আমার একটা অভ্যাস খারাপ ঐ যে আগবাড়িয়ে কথা ঠোঁটকাটা স্বভাব; নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করি সে কে হয় আপনার? খুব রুগ্নশুকনো মননে বললেন মেয়ে।
ওহ! গ্রুপ দেখে আমার সাথে না মিলায় পরে লক্ষ্য করি মুখটায় বিষন্নতার ছোঁয়া। আশ্বস্থ করি সমস্যা নেই। কখন কোন দিনে কার রক্ত দেওয়ার লাস্ট দিন এটা আমার অজানা নেই অন্তত আমাদের ব্যাচের। বন্ধু হৃদয়কে ফোন দেয়। দোস্ত, কোথায় আছিস। বলল লেমন লাইমে। ও, তাহলেতো কাছাকাছি একটু গেটে আয় না। বলল, ঠিক আছে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর।
এসে সে তাদের দেখে এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল। ক্লাস নেই। ফাঁকা পিরিয়ড কালবিলম্ব না করে তখনই আমাদের নিয়ে মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজের উদ্দেশ্য রওনা হল। লেখাপড়া না জানা
মূর্খ মানুষ এত কিছু কি আর বুঝে। না জানার কারণে হসপিটালে অনেক শিক্ষিতরাও রুম চিনতে হিমসিম খায়।
ব্যারাম তাই আসছে। আগে তো আসা হয়নি এই মেডিকেলে। রক্ত দিতেও ক্রস ম্যাচিংয়ের জন্য অর্থ পরিশোধ করতে হয়। লম্বা লাইন। প্রায় প্রোসেসিং করতে করতে দেড় ঘন্টা লেগে যায়। অপেক্ষা, এখন দুই ঘন্টা পর পুনরায় আসতে হবে। আমাদের আরেকটা ক্লাস আছে দুই পিরিয়ডের। তাই এদিক ওদিক না ঘুরে বেরিয়ে পড়লাম। একজন এগিয়ে দিতে আসল। মুখের সাদা দাড়ি দেখে চিনতে আর বাকি রইলো না। এ বার জানলাম মেয়েটা ওনার। এবং যিনি ভার্সিটির সামনে প্লাকার্ড নিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন ওনি আঙেলের সহধর্মিণী । মেডিকেলের পেছনে কাঠাসম কাশের জঙ্গল তার মাঝবরাবর সরু পথ মেইন রোড পর্যন্ত। আমাদের সাথে ভার্সিটি এলেন।
ভার্সিটির স্টাফ তিনি। মসজিদ দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত। খুব অমায়িক। নম্রও ভদ্র। কারো আচরণে কষ্ট পেলে কিঞ্চিৎও রাগান্বিত হন না। প্রায় অনেকে মসজিদে জোহরের নামাজের আগে আগে চলে যায় কেহ নামাজ পড়ে কেহ গল্প করে। এজন্য স্বাভাবিক ভাবে বলেন নামাজের সময় ছাড়া বাইরে থাকবেন প্রিয় মামারা। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ। তবু শুনে না। প্রায় এমনটা ঘটে থাকে তবু কটুবাক্যও ব্যবহার করেন না। সহজ সরল মনের একজন। কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন তোমরা আমার ছেলের বয়সের চেয়েও ছোট। ভুলতো করতেই পারো আর আমি এখানে দায়িত্ব পালন করি। তোমাদের উপর রাগ করে কি হবে? আমার দায়িত্ব আমি ঠিক ভাবেই পালন করি। তিনি খুব ধৈর্যশীল। হাসিখুশি থাকেন। আমাদের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলেন।
আজও সাবলিলভাবে কথা বললেন। অবস্থা অবলোকন করে কিছুটা আঁচ করতে পারছি, কতটা কষ্ট বুকে নিয়ে কথাগুলো বললেন। হয়তো
নিম্নআয়ের মানুষজন যা পায় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। কখনো দুখি মুখ দেখাতে চান না। দুঃখ আড়াল করে হাসেন। দীর্ঘদিন থেকে অসুস্থ। এ বয়সে এসেও মেয়েকে টানতে হবে এটা ভাবতেই পারে না। নিয়তির খেলা মানতেই হবে৷ স্বামী, কোন যোগাযোগ রাখে না তিন মাস যাবত । বাবার বাসায় থাকে। এভাবেই দিন যায়। ব্রেস্টক্যান্সারে আক্রান্ত। আবার অন্তঃসত্ত্বাও। খুব হয়েছে,, আর কত বাবা করবে। বয়সতো আর কম হল না। বাবা তো ফেলেও দিতে পারে না মেয়েকে। ফেলে দিলে যে বাবা নামে কলঙ্কের ছাপ লেগে যাবে। এসব ভাবেন। আর পাঁচটা বিত্তশালী বাবার মত নন। তবে তার মনের জোর, আশা, ভরসা ও আত্মবিশ্বাস যে বিত্তবানদেরও হার মানায়। কত বিত্তবান আছে অগণিত ধনসম্পদ দালান বাড়ি গাড়ি থেকেও শান্তিমত স্বাভাবিক রাত্রি যাপন করতে পারে না। এত এত অর্থ সম্পদ মালসামানায় অশান্তির কারণ ! বরং যাদের ধনসম্পদ নেই, বিলাসিতা নেই তারা কতই না সুখ সাচ্ছন্দ্যে দিন অতিবাহিত করছে। তেমনই আঙ্কেলও একজন। যার কোনো অহংবোধ নেই। চাওয়া পাওয়ার প্রাপ্তিতে আছে মানুষের মন জয় করা অমায়িক ব্যবহার। মানুষকে কদিনের জন্য এগিয়ে নেওয়া বা মন জয় করা তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য কোন বিষয় নয়। এটা চিরন্তন পুণ্য যার তুলনা হয় না। তুলনাবিহীন। দীর্ঘক্ষণ একই অসুখে ভোগার দরুণ। বড় সমস্যা দেখা দেয়। পথ খোলা
একটা অপারেশন। দিনের আলোয় সব পরিস্কার। আর কত আসল চেহারা লুকিয়ে রাখবে। যতই ঢাকে ততই যেন প্রকাশ হয়ে যায়। বাবা বলেই তারা আড়াল করতে পারেন। বললাম আঙেল যদি কিছু মনে না করেন। একটা কথা বলি, আমাদের বিভিন্ন সোসাইটির ফান্ড আছে আর ভার্সিটিরও ফান্ড রয়েছে। কিছু একটা ব্যবস্থা,,, বলতেই থামিয়ে দিয়ে বললেন। না না বাবা আমার যা আছে তা দিয়ে চলতে পারব। আর মরে যাব তবু হাত পাতবো না কারো কাছে! মনে হল
তিনি লজ্জায় পেলেন কথাগুলো আমতা আমতা করে বললেন যেন এগুলো ওনার হৃদয়ের বিরুদ্ধে কথা । হয়তো বলতে চাইছেন যদি একটা ব্যবস্থা হত, খুব ভাল হবে। হাতের অবস্থাও ভাল যাচ্ছে না। আর পারছি না বাবা। পথে বসেছি। কিন্তু কেন? তিনি এতটাই নিজ হৃদয়ে চিরায়ত কথা লুকাতে চাইছেন। নিজের ব্যক্তিত্ব হারানোর ভয় কি? মানুষ বিপদে পড়লে এসব কি মনে থাকে? উদ্ধার হলে একটা পর্যায়ে চলে আসে। এসব কেউ মনে রাখে?
আমাদের সমাজে যারা প্রকৃত পাওয়ার যোগ্য তারা বঞ্চিত। যারা পাওয়ার যোগ্য না, চিটার, বাটপার এদের কপালেও অনুদান জুটে! এই কিছু ব্যক্তির জন্য অসম্মান লাঞ্চনার ভোক্তাভোগী প্রকৃতরা। আমাদের সমাজও তাই যে প্রয়োজনে কেহ হাত পাতলে সেটা সাহায্য চাওয়া মনে করে নেয়। দুঃখজনক। পরের জন্য কিছু করতে পারা এটাতেই পরিতৃপ্তি ও চূড়ান্ত স্বার্থকতা রয়েছে। মানুষ কেন ভাবে না মুসিবতে অপরের কাছে হাত পাতা মানে এই নয় যে পাওনা কিছু চাইছে, একটু হলেও বোঝার চেষ্টা করা দরকার। কেউ কারো কাছে সহজে হাত পাতে না। যখন কিছুই করার থাকে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে ঠেকে যায় অবস্থা ঠিক তখনই মানুষের আর পিছনে যাওয়ার অপশন থাকে না। হয় সামনে যেতে হয় নয়তো সে অবস্থানেই বলি হতে হয়।
হয়তো ভয় হচ্ছে ওনার। আজকে হাত পাতলে আমার সহযোদ্ধারা কী বলবে? ইউনিভার্সিটির সামান্য স্টাফ এই পরিবেশ কি পারবে তাকে মানিয়ে নিতে। না হাসি তামাসার পাত্রতে পরিণত হবে। হয়তো সেদিক খেয়াল করেই তিনি গোপন করতে চাচ্ছেন সাহায্য প্রয়োজন।
ক্লাস শেষে বসে অাছি চেয়ারে হৃদয়ের জন্য আর এগুলোই ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তুরাগের পাড়ে তাকায় জানালার ফাঁক দিয়ে। শরতের বাতাসে কাশফুল দোলে। কী সুন্দর একজন আরেকজনের কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে হাসে আর সাম্যপ্রীতির গান গায়। নেই কারো প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ। ফুলের কাছে সহানুভূতি শেখাও মনষত্বের কাজ। এর মাঝে হৃদয় এসে হাজির হয় তাকে সাথে নিয়ে রওনা হই লাল ভালবাসার টানে।
-লেখকঃ আজম সিদ্দিক রুমি