Thursday, June 1, 2023
বাড়িপ্রবন্ধস্থাপত্যের ইতিহাসঃ স্থপতিদের স্থপতি মিমার সিনান

স্থাপত্যের ইতিহাসঃ স্থপতিদের স্থপতি মিমার সিনান

যদি আমরা স্থাপত্যের ইতিহাসের দিক তাকাই, দেখতে পাবো ইতিহাসজুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রতিভাবান মুসলিম স্থপতিদের (architect) গল্প। কালের স্রোতকে চ্যালেঞ্জ করা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অসংখ্য স্থাপত্য নিদর্শন মুসলিম স্থপতিদেরই কীর্তি, যারা যুগ যুগ ধরে ঐন্দ্রজালিক ও চমৎকার সব স্থাপনা তৈরীর মাধ্যমে ইসলামের মহিমা তুলে ধরার চেষ্টা করে এসেছেন। জেরুজালেমের ডোম অভ রক,  ভারতের আগ্রার তাজমহল, আন্দালুসিয়ার গ্রানাডায় আল-হামরা প্রাসাদ এবং ওসমানী খিলাফতের ইস্তাম্বুলের সুলতান আহমেদ জামে মসজিদ (Blue Mosque) হচ্ছে সেসব রমণীয় এবং সযত্নে লালিত স্থাপনার ঐতিহ্যের উদাহরণ।

তেমনই স্থাপত্যের বর্ণিল স্বপ্নকে ছুঁয়েছেন এবং নির্মাণ করেছেন অসম্ভবপ্রায় স্থাপনা – এমন একজন মহান স্থপতি মিমার সিনানকে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থপতি হিসেবে মনে করা হয়। যিনি জন্ম গ্রহণ করেন ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ওসমানী সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের শাসনকালের স্মৃতিস্তম্ভ- ল্যান্ডমার্ক। এই সময়কালে মিমার সিনান নির্মাণ করেন তার অসাধারণ সব স্থাপনাসমূহ এবং চিরকালের জন্যে বদলে দেন স্থাপত্যের দিগন্তরেখা।

সিনানের জীবনের সূচনা ছিলো ওসমানী খিলাফতের সামান্য একজন সৈনিক হিসেবে, কিন্তু তিনি অল্পদিনেই তাঁর সেই বাহিনীতে তরুণ ও তুখোড় প্রকৌশলী হিসেবে প্রতিভার সাক্ষর রাখতে শুরু করেন এবং একের পর এক সামরিক র্যাংক পাড়ি দিয়ে সামরিক অফিসার পদে উন্নীত হন। অফিসার হিসেবে তিনি সুলতান প্রথম সেলিম ও সুলতান সুলেয়মান কানুনির অধীনে অনেক সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।

ওসমানী সেনাবাহিনীর ইউরোপ, আফ্রিকা এবং পারস্যজুড়ে নতুন নতুন বিজয়াভিজানগুলোতে মিমার সিনান সেনাবাহিনীর প্রকৌশল সংক্রান্ত বিষয়াদি এবং একইসাথে নতুন বিজিত শহরগুলোতে দূর্গ, মসজিদ ও আবাসিক এলাকা তৈরীর দায়িত্বে ছিলেন।  তার স্থাপত্য প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ খলিফা ১৫৩৮ সালে তাঁকে ইস্তানবুলে খিলাফতের প্রধান স্থপতি হিসেবে নিয়োগ দেন।

তুর্কী আর্কিটেকচারাল মাস্টারপিসগুলোর মাঝে আয়া সোফিয়া (Hagia Sophia) এক চিরন্তন রত্ন। ওসমানী স্থপতিগণ মসজিদ নকশার জন্য আয়া সোফিয়ার বিশালাকৃতির গম্বুজকে আদর্শ হিসেবে ধরে নেন। এজন্যওসমানী খিলাফতের সময়ে নির্মিত মসজিদসমুহে সুবিশাল সেন্ট্রাল ডোম/গম্বুজ দেখা যায়, এতে মসজিদের আকার ও ধারণক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়। যুগ যুগের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়ও তৎকালীন কোন স্থপতিই বিশালতা ও সৌন্দর্যে আয়া সোফিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের কাছেও যেতে সক্ষম হননি। তাই মিমার সিনানের লক্ষ্য ছিলো ইসলামের জন্য এমন এক স্থাপনা তৈরি করা, যা মহাকাব্যিক আয়া সোফিয়ার বিশালতাকে ছাপিয়ে যাবে।

 স্থপতিজীবনের শুরুতে তিনি খিলাফতের এলাকা জুড়ে অনেকগুলো মসজিদ, ব্রিজ, ওয়াটার ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (aqueduct) ইত্যদি নির্মাণ করেছিলেন, তাই আর্কিটেকচারাল ডিজাইনে সিনানের অভিজ্ঞতা ছিলো প্রশ্নাতীত। এই প্রকল্পগুলো স্থাপত্য ও প্রকৌশলবিদ্যায় মিমার সিনানের গভীর ও শক্ত অবস্থান গড়ে দিয়েছিলো, যা পরবর্তীতে তাকে আরও বড় আরও অনেক বেশি গৌরবোজ্জ্বল ইসলামী স্থাপত্যকর্ম নির্মাণের রাস্তা গড়েছিলো। নিচে সম্মানিত পাঠকদের জন্য উল্লেখযোগ্য অল্প কিছু নির্মাণ নিয়ে আলোচনা করা যাকঃ

শেহজাদে ও সুলেয়মানিয়ে মসজিদঃ 

সুলতান সুলেমানের ছেলে মেহমেদ ২১ বছর বয়সে ১৫৪৩ সালে মৃত্যুবরণ করলে সুলতান তার সম্মানে ইস্তানবুলে স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য বৃহৎ একটি মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। শেহজাদে জামি কেবল একটি মসজিদই ছিলোনা; ছিলো কমপ্লেক্স, যেখানে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, লঙ্গরখানা— মুসাফিরদের জায়গা এবং মেহমেদের কবর ছিলো। সুলতান সুলেমান সিনানের এই নজরকাড়া ও নিখুঁত কাজে খুবই সন্তুষ্ট হলেও সিনান একে নিজের সেরা কর্ম হিসেবে ভাবতে পারেননি।

 

সিনানের অধীনে দ্বিতীয় প্রধান মসজিদ ছিলো সুলতান সুলেমানের নিজের জন্য। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব, আধিপত্য ও মহিমা ফুটিয়ে তুলতে তিনি এই মসজিদকে ইস্তানবুলের দিগন্তরেখার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করতে চাইলেন। গোল্ডেন হর্ন এর পাহাড়ে মসজিদের স্থান নির্ধারণ করা হয়; ফলে অনেক দূর থেকেও এই স্থানটিকে সহজে সনাক্ত করা সম্ভব। মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয় প্রায় ৭ বছরে। মসজিদটির ভিত্তিস্থাপনের পর সিনান হঠাৎ ৫ বছরের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এতে ক্ষুব্ধপ্রায় সুলতান জানতে চান, তার প্রিয় স্থপতির কি হয়েছে! পাঁচ বছর পরে ফিরে এসে সুলতানকে সিনান ব্যাখ্যা দেন যে, মসজিদটির আকার ও ব্যাপকতা এতই বিশাল হবে যে নির্মাণ কাজ শুরু করার আগে এর ফাউন্ডেশন মজবুতভাবে প্রকৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে কমসেকম পাঁচ বছর সময় দরকার ছিলো! 

১৫৫৭ সালে যখন মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয়, তখন এটি সত্যিকারের ‘আর্কিটেকচারাল মাস্টারপিস’ হিসেবেই বিবেচিত হলো। মসজিদের ইন্টেরিয়র, উচ্চতা এবং সুক্ষ্ম কারুকার্যের বিবেচনায় সুলেয়মানিয়ে মসজিদের সমতুল্য অন্য কোন মসজিদ তখন পর্যন্ত ইস্তাম্বুলে ছিলোনা। এর সরু-উঁচু চারটি মিনার এবং ৫০ মিটার উঁচু গম্বুজ— স্থাপত্য ও প্রকৌশলের যেকোনো বিচারে একে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলো। মসজিদ কমপ্লেক্সে ছিলো একটি হাসপাতাল, গোসলখানা; লাইব্রেরী ছিলো যেটি আজও ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও লঙ্গরখানা, অনেকগুলো কুরআন শিক্ষার মাদ্রাসা, একটি হাদিস শিক্ষালয় এবং শিশুদের বিদ্যালয় ছিলো। কমপ্লেক্সটির একাংশে গোরস্থান ছিলো, যেখানে সুলতান সুলেমানকে মৃত্যুর পর দাফন করা হয়।

মসজিদের কেন্দ্রে ছাঁদের সাথে ছিলো একটি বৃহদাকার ঝাড়বাতি। মসজিদের আভ্যন্তরীণ পরিবেশ ঠিক রাখার কথা চিন্তা করে সিনান এই মসজিদে বিশেষ ধরনের জানালা ব্যাবহার করেন। যেই জানালাগুলোতে একটি বিশেষ ব্যবস্থা থাকতো মসজিদে ব্যবহৃত মোমবাতি থেকে নির্গত মোম বাতাসের ধুলোকে জমিয়ে ঝুল হিসেবে জমা করতে, এই ঝুলকে ক্যালিগ্রাফারদের ব্যবহৃত কালিতে রুপান্তরিত করা যেতো। মসজিদটির ইন্টেরিয়র তখনকার অন্যান্য মসজিদের মত সূক্ষ্ম ডেকোরেশন ছিলো না; বরং এর নান্দনিকতা ছিলো এর সরলতায় এবং আভিজাত্যে। মসজিদের বাইরের দিক ‘Iznik tile’ এ তৈরি, যা আয়াতুল কুরসী অঙ্কিত। এই মসজিদের সৌন্দর্য এবং গগনচুম্বি বিশালতা সত্ত্বেও, সিনান মনে করতেন যে তিনি এরচেয়েও ভাল কিছু করতে পারবেন।

সেরা শিল্পকর্মঃসেলিমিয়ে মসজিদ

১৫৬৬ সালে সুলতান সুলেমানের মৃত্যুর পর তার পুত্র খলীফা দ্বিতীয় সেলিম নিজের নামে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তবে তিনি ইস্তানবুলে নয়; Edirne শহরে এই মসজিদের নির্মাণ করতে চাইলেন।  এর নির্মাণ শুরুর সময় সিনান সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, তিনি হাজিয়া সোফিয়ার শ্রেষ্ঠত্বকে পিছনে ফেলার লক্ষ্যে ছিলেন অটল। অবশেষে ১৫৭৪ সালে মসজিদটি নির্মাণ সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে উনি এ লক্ষ্য অর্জনে সফল হন।

 

যদিও বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে সেলিমিয়ে মসজিদ ও সুলেয়মানিয়ে মসজিদের ভেতর মিল রয়েছে; কিন্তু কোন ধরনের পিলার বা অর্ধ- গম্বুজের সাহায্য ছাড়া নিজের উপরই গড়ে উঠা বিশ্বের উচ্চতম গম্বুজওয়ালা এই মসজিদটি ছিলো তখনকার সারা পৃথিবীর তাবৎ স্থাপনার চেয়ে উঁচু। বর্তমানে এটি Edrine –র প্রধান মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত এমন এক স্থাপত্যশিল্প, যার কোনো তুলনা নেই।

সেসময়ে এর মিনারগুলো ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মিনার, যার প্রতিটির উচ্চতা ছিলো ৮০ মিটারেরও বেশি। মসজিদের গম্বুজটি ছিলো একটি অষ্টকোনী ফাউন্ডেশনের উপর নির্মিত, ফলে এটি উচ্চতায় হাজিয়া সোফিয়ার গম্বুজকেও ছাড়িয়ে যেতে সফল হয়।

 বিদায়ঃ 

মহামতি স্থপতি মিমার সিনান ৯৮ বছর বয়সে ১৫৮৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে তাঁর সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক সুলতান সুলেমানের কবরের কাছে সুলেয়মানিয়ে মসজিদ চত্বরে সমাহিত করা হয় । সিনান নির্মাণ করেছেন ওসমানী খিলাফতের সর্বশ্রেষ্ঠ স্মৃতিস্তম্ভগুলো। তিনি সারা জীবনে ৯০টিরও বেশি বড় মসজিদ, ৫০টি ছোট মসজিদ, ৫৭টি মাদ্রাসা/বিশ্ববিদ্যালয় ,৮টি ব্রীজ এবং অসংখ্য পাবলিক বিল্ডিংয়ের প্রধান স্থপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর্কিটেকচারাল যে প্রভাব তিনি তৈরি করেছিলেন, এর যে ধারা মুসলিম বিশ্বের উপর রেখে গিয়েছেন, তা শুধু বিশালাকৃতির মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা। পরবর্তীতে তার ছাত্ররা সমগ্র বিশ্বজুড়েই নির্মাণকাজের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছিলেন, যার অন্যতম বড় উদাহরণ ইস্তানবুলের সুলতান আহমেদ মসজিদ (Blue Mosque) এবং ভারতের আগ্রার তাজমহল।

মিমার সিনানকে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম স্থপতি হিসেবে এজন্য বিবেচনা করা হয় যে মৃত্যুর ৪০০ বছর পরও তিনি প্রাসঙ্গিক। তাঁর কাজ এখনো ইসলামের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে গণ্য হয়।

লেখকঃ সাদী মোহাম্মদ সাদ

শিক্ষার্থী, স্থাপত্য বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
সম্পর্কিত প্রবন্ধঃ

মন্তব্য বাদ দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন

সবচেয়ে জনপ্রিয়