– ড. ফেরদৌস আলম ছিদ্দিকী
মানুষের মনের আকাঙ্খা, চিন্তা—চেতনা, আবেগ—অনুভূতি ও ভাব প্রকাশের বাহনই ভাষা। মানুষ একে অপরের সাথে কথা বলে ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে। এজন্য একে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের সেতু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য এক অকৃত্রিম উপহার। আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করে তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি পৃথিবীতে আগত সকল নবী—রাসূলকে স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন, যাতে তারা স্বীয় জাতিকে দীনের দাওয়াত স্পষ্টভাবে পেঁৗছাতে পারেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি রাসূলগণকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে দীন বোঝাতে পারেন’ (সূরা ইবরাহীম: ০৪)। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী’।
সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানবসভ্যতার পাশাপাশি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাষারও বিবর্তন ঘটেছে। জন্ম হয়েছে অসংখ্য ভাষার। ভাষা বৈচিত্র মহান আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তভুর্ক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে’ (সূরা রুম: ২২)। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস’ এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা ৬৯০৯টি। এর মধ্যে অনেক ভাষা লুকিয়ে আছে, অনেক ভাষা বিলুপ্তপ্রায়, অনেক ভাষা পরিবর্তন হয়ে ভিন্নরূপ ধারণ করেছে, আবার অনেক ভাষায় কথা বলে গুটি কয়েক মানুষ। বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত ভাষা ১১টি। এগুলো হচ্ছে চাইনিজ, ইংরেজি, হিন্দি—উর্দু, স্পানিশ, আরবি, পর্তুগিজ, রাশিয়ান, বাংলা, জাপানি, জার্মান ও ফরাসি। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভাষা ব্যবহৃত হয় পাপুয়া নিউগিনি ও ইন্দোনেশিয়ায়। পাপুয়া নিউগিনিতে ৮৩২টি এবং ইন্দোনেশিয়ায় ৬৭০টি ভাষা প্রচলিত রয়েছে। চিনের ম্যান্ডারিন ভাষা ও আফগানিস্তানের পশতু ভাষা পৃথিবীর জটিল ও কঠিন ভাষা হিসেবে পরিচিত।
বিশ্বব্যাপী অসংখ্য ভাষার মধ্যে বাংলাভাষা অনন্য। বাংলা আমাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা। বাংলাভাষার উৎপত্তি কখন ও কিভাবে হয়েছে সেটি নিরূপণ করা কঠিন। তবে ভাষা বিজ্ঞানীগণ মনে করেন, এ অঞ্চলের স্থানীয় ভাষার সাথে বহিরাগত আর্যদের ভাষার সংমিশ্রণে প্রাকৃত—অপভ্রংশ রূপ ধারণ করে দীর্ঘদিন যাবৎ অনেক পরিবর্তন—পরিবর্ধনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। এ হিসেবে চর্যাপদের পালি ভাষাকেই বাংলাভাষার প্রাচীন নিদর্শন বলা হয়ে থাকে। কিন্তু পালরাজাদের পরাজিত করে সেনদের শাসন চালু হলে বাংলাকে কোণঠাসা করে রাখা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যের প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। ভারতের বিহার, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের অনেক লোক বাংলাভাষাতেই কথা বলে। বর্তমানে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়ে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়।
মুসলিম শাসনামলে বাংলাভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। তুর্কি শাসনামলে ফার্সি রাষ্ট্রভাষা থাকলেও এ সময় বাংলাভাষাকে অবজ্ঞা করা হয়নি। পরবর্তী মুসলিম শাসকগণও বাংলাভাষায় সাহিত্য চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছেন। কিন্তু ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার শাসকের পরিবর্তনের সাথে ভাষা ও সংস্কৃতিরও পরিবর্তন সাধিত হয়। এতে বাংলা ভাষার পুনর্জাগরণ স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং নিম্নমানের মিশ্রভাষার ‘পুথি সাহিত্য’ ও ‘কাবিয়াল গান’ এর আবির্ভাব ঘটে। এ সময় ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়। ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ব্যাঘাত ঘটলেও পরবর্তীতে উন্নতি সাধিত হয়। ইংরেজ শাসনামলেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে। তবে মুসলিম ও ইংরেজ শাসনামলে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি ও প্রসার ঘটলেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়নি। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান হলে বাংলাদেশের (তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান) অধিবাসীরা বাংলাভাষা নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখেন। তারা বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী উত্থাপন করেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে কোন ভাষার দাবী আদায়ের জন্য কাউকে আন্দোলন—সংগ্রাম করতে হয়নি এবং কাউকে প্রাণও দিতে হয়নি। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য লড়াই করতে হয়েছে এবং প্রাণও দিতে হয়েছে। এজন্য ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ আন্দোলন আমাদের জাতিসত্তার রক্ষাকবচ। বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশের মানুষের সংগ্রাম বা আত্মত্যাগ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, হতাশা, অপমান, শোষণ—নিষ্পেষণ, সর্বোপরি নিজের ভাষার জন্য অকুণ্ঠ ভালোবাসা। ১৯১১ সালে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সর্বপ্রথম রংপুরে মুসলিম প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাভাষা আমাদের মাতৃভাষা’। ১৯১৮ সালে স্বাধীন ভারতের সাধারণ ভাষা কি হবে সেটি নিয়ে বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে বলেন, ‘শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলাভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ’।
১৯২১ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এক লিখিত প্রস্তাবে বলেন, ‘ভারতের রাষ্ট্রভাষা যাই হোক, বাংলার রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বাংলা ভাষাকে’। ১৯৩৭ সালের এপ্রিলে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় মাওলানা আকরাম খাঁ রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে দীর্ঘ সম্পাদকীয় লেখেন।
পাকিস্তান রাষ্ট প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাস পর ১৯৪৭ এর ডিসেম্বরে করাচি শিক্ষা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বাংলাভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পূর্ব বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটিই ছিল সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্রসভা। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ববাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা বিষয়ে একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি উদুর্ ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাভাষা ব্যবহারেরও দাবি জানান। ২৫ ফেব্রুয়ারি সংশোধনী প্রস্তাবের উপর আলোচনা শুরু হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার মাধ্যমে ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করাই এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য। পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঘোষণা করেন, ‘পূর্ববাংলার অধিকাংশ অধিবাসীরই এ মনোভাব যে, একমাত্র উদুর্কেই রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যেতে পারে’। এমতাবস্থায় সংশোধনী প্রস্তাবটি সাম্প্রদায়িকতায় পর্যবসিত হয়। এর প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সর্বদলীয় সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং বাংলাভাষা দাবি দিবস ঘোষণা দেয়া হয়।
১৯৪৮ এর ২১ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে কায়েদে আজম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সভায় তিনি বলেন, ‘উদুর্ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, তখন উপস্থিত অনেকেই ‘না’, ‘না’ বলে প্রতিবাদ করে। এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা চরম প্রতিবাদ জানায়। এ সময় ঢাকাসহ সারা দেশে বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানে এক ভাষণে পুনরায় বলেন, ‘উদুর্ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের করে। এতে পুলিশ হামলা করলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শহীদ হন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দীন ও আবদুস সালাম। ২৩ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল। জনগণ ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে আসে। পরিশেষে জনরোষের মুখে পাকিস্তান মুসলিম লীগ ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মাইল ফলক। ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে বাংলাভাষা উদুর্র পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাভাষা একক রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রবর্তিত হয়। স্বাধীনতা উত্তর ২১ ফেব্রুয়ারি কখনো ‘জাতীয় শোক দিবস’ আবার কখনো ‘জাতীয় শহীদ দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। সর্বস্তরে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো ১৯৯৯ এর ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘভুক্ত দেশসমূহে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। আফ্রিকা মহাদেশের সিয়েরালিওনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম, আলোচনায় স্থান পেয়েছে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের মহিমা এবং বাঙালির শৌর্য ও বীরত্বের কথামালা।
মাতৃভাষার অধিকার এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে বাংলাভাষী মানুষ বিশ্বের দরবারে সম্মান ও মর্যাদার আসনে সমাসীন হলেও আজও পর্যন্ত নিশ্চিত হয়নি সামাজিক মর্যাদার প্রত্যাশিত আসন। বিভিন্ন ধরনের অভ্যন্তরীন সমস্যায় জর্জরিত আমাদের বাংলাভাষা।
শিক্ষা ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এবং প্রচার মাধ্যমে ইংরেজিপ্রীতি বাংলাভাষার সামগ্রীক অর্জনের পেছনে এক অশনী সংকেত। ভাবপ্রকাশে জাতিগত হিনমন্যতা বাংলাভাষী মানুষের জন্য চরম অপমানের। ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হবার সাত দশক পার হলেও আজও তৈরি হয়নি এর নির্ভরযোগ্য ইতিহাস। আন্দোলনের প্রথম সারির নেতৃত্বে কারা ছিলেন, কতজন শহীদ হয়েছেন, কতজন আহত হয়েছেন এবং এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত? সেটি আজও আমাদের বোধগম্য নয়। বাংলাভাষার প্রমিত বানান এবং উচ্চারণে আমাদের অনীহা দিনদিন বেড়েই চলেছে। প্রচার মাধ্যম এবং পাঠ্যপুস্তকসহ সকল মাধ্যমেই চলছে ভাষার যথেচ্ছ বানান ও উচ্চারণ প্রবণতা। এমনকি বাক্যগঠনে ও অনুকরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় বাংলাভাষা হারাচ্ছে তার স্বকীয়তা। এছাড়া বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনাকে শিল্প খাত হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় এবং এক্ষেত্রে কোন নীতিমালা না থাকায় এখানে বিরাজ করছে ভয়াবহ অরাজকতা। নোটবই প্রকাশের অভয়ারণ্য সৃষ্টির মাধ্যমে জাতির সৃজনশীলতা বিনষ্টের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। প্রকাশনা ও বিপণনেও রয়েছে নিয়ন্ত্রনহীন অস্বচ্ছতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অদ্যাবধি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বাংলা অভিধান ব্যবহারের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এর সহজলভ্যতাও নিশ্চিত করা যায়নি। বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও বাংলাভাষার যথার্থ শিক্ষা প্রদানের উপযুক্ত শিক্ষক বিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমান প্রজন্ম ও বিশ্ববাসীর কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব উপস্থাপনের জন্য রাষ্ট্র, সরকারি—বেসরকারি প্রচারমাধ্যম, বাংলা একাডেমিসহ অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসা উচিত ছিল।
বাংলাভাষা আমাদের প্রাণের ভাষা, অহঙ্কারের ভাষা। এ ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে আমাদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাভাষার শুদ্ধ চর্চা ও লালনকে প্রণোদনা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষক ও অনুশীলনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক্ষেত্রে জেলা শিল্পকলা একাডেমিকে প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। জেলা পর্যায়ে সরকারি প্রশিক্ষক নিয়োগ করে ভাষাশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দ্বার উন্মোচন করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে ভাষার আভিজাত্য রক্ষার গুরু দায়িত্ব পালন করা উচিত। নিয়মিতভাবে ভাষাবিষয়ক গবেষণা ও প্রকাশনাকে উৎসাহিত করাও আবশ্যক। পাঠ্যসূচিতে সুস্থ ও সুন্দর মানস গঠনের উপযোগী বিষয় সংযুক্ত করতে হবে। চলচ্চিত্র, নাটক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে ভাষার প্রায়োগিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রকে সুপ্রসন্ন করা যেতে পারে। টেলিভিশন, রেডিও এবং ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যমে ভাষাবিষয়ক আলোচনা ও শিক্ষাবিষয়ক অনুষ্ঠানের আয়োজনও এক্ষেত্রে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া ভাষাবিষয়ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে শিক্ষার্থীদেরকে ব্যাপকভাবে ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগে অভ্যস্ত করে গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলাভাষার একটি কোর্স বাধ্যতামূলক করা বাঞ্ছনীয়। বাংলাভাষা যাতে সামাজিক—সাংস্কৃতিক পেষণের শিকার না হয় সেদিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। সর্বোপরি এ ভাষার স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাকরণ রচনার উদ্যোগ এবং ভাষা প্রয়োগে সকল প্রকার বিভ্রাট দূর করার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হবে।
পরিশেষে বলতে পারি বাংলাভাষার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গ অঞ্চলের স্থানীয় ভাষা। বর্তমানে এটি বিশ্বের অন্যতম প্রধান ভাষা। সুলতানি ও মুঘল আমলের মুসলিম শাসকবর্গও এ ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। অন্যদিকে আধুনিককালের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীও এ ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সংগ্রাম করেছেন, জীবন দিয়েছেন। অনেক শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মুখের ভাষা যেন কোন আগ্রাসী শক্তি জোর করে ছিনিয়ে নিতে না পারে, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকারকে কোন দুষ্টচক্র যেন হরণ করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজের ভাষাচর্চার যে স্বাধীনতা পেয়েছি সে পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে আজীবন। ধাপে ধাপে সমৃদ্ধ করতে হবে প্রিয় বাংলাভাষাকে। এছাড়া বাংলাভাষার অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে রক্ষা করতে হবে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা—সার্বভৌমত্বকে।