25 C
Dhaka
Wednesday, December 6, 2023
বাড়িবাংলাদেশবিজয় দিবসের অঙ্গীকার

বিজয় দিবসের অঙ্গীকার

বর্তমান পৃথিবীতে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত স্বাধীন দেশ ১৯৩টি। এ সকল সদস্য দেশের মধ্যে অনেক দেশ বরাবরই স্বাধীন দেশ হিসেবে থেকেছে। আবার অনেক দেশ পরাধীনতা থেকে বা কলোনী থেকে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কোন দেশ আলোচনার মাধ্যমে আবার কোন দেশ বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হয়েছে। এ পর্যন্ত যতগুলো দেশ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— আমেরিকা, হাইতি, চিলি, বলিভিয়া, বেলজিয়াম, আলজেরিয়া, ইরিত্রিয়া ও বাংলাদেশ। আমেরিকা ১৭৭৬ সাল থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে স্বাধীন হয়। হাইতি ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে ১৭৯১ সাল থেকে ১৮০৪ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে। এটি ছিল ল্যাটিন আমেরিকার প্রথম স্বাধীন দেশ। স্পেনের সাবেক উপনিবেশ চিলি দীর্ঘ আট বছর যুদ্ধ করে ১৮১৮ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। বলিভিয়া ১৮০৯ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে। এটিও স্পেনের একটি উপনিবেশ ছিল। ১৮২৫ সালে স্প্যানিশ রাজকীয় বাহিনীর জেনারেল পেড্রো অ্যান্তোনিও অলানেতার পরাজয় এবং মৃত্যুর মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয় এবং বলিভিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। বেলজিয়াম ১৮৩০ সালে নেদারল্যান্ডসের সাথে মাত্র ১০ দিন যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়। আলজেরিয়া ফ্রান্সের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে ১৯৫৪ সালের ১ নভেম্বর। প্রায় আট বছর ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। ইরিত্রিয়া ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ১৯৯৩ সালে গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে যেমন করুন, শোকাবহ ও লোমহর্ষক; অন্যদিকে ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত ও বীরত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এ যুদ্ধের সূচনা হয় এবং দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মাধমে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভেীম রাষ্টের অভ্যুদয় ঘটে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক পটভূমি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন এক ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ—উদ—দৈৗলা ইংরেজদের নিকট পরাজিত হন। সেখান থেকেই বাংলার স¦াধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। বাঙালি জাতি চলে আসে ইংরেজদের শাসনাধীনে। ইংরেজরা প্রায় দু’শ বছর বাংলার মসনদ পরিচালনা করে। বিজাতীয় শাসন, শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়নের যাঁতাকলে বাঙালি জাতি নিষ্পেষিত হয়। এক পর্যায়ে বাঙালি জাতি বিক্ষুব্ধু হয়ে ওঠে। তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলে বৃটিশরা এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব পাকিস্তান তখন একটি স্বাধীন রাষ্টের অংশ হলেও প্রকৃত স্বাধীনতা তারা কখনই ভোগ করতে পারেনি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের উপর যুলুম ও শোষণের স্টীম রোলার চালাতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আর্থ—সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে চরম শোষণের শিকার হতে হয়। এমনকি তারা এ অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকেও কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি তৈরি হয়।


পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। পাকিস্তান সরকার তাদের এ যৌক্তিক দাবির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে ১৯৪৮ সালে উদুর্কে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এ অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ চলতে থাকে যেটি পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছাত্র জনতা একত্রিত হয়। পুলিশ এ জনসমাবেশের উপর গুলি চালানোর ফলে রফিক, সালাম, বরকত ও জব্বারসহ অনেকেই শাহাদাত বরণ করেন। এ ঘটনা আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দান করে এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে ১৯৫৬ সালে চূড়ান্তভাবে সংবিধানে বাংলাকে উদুর্র পাশাপাশি অন্যতম প্রধান জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালির এ আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি। মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। ১৯৫৯ সালে সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা হলে বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ বাঙালি হওয়ায় নির্বাচনের ফলাফল পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে যাওয়ার চিন্তা করে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একই সময়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের কৌশল হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যেও বিরোধ সৃষ্টি করে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়।
১৯৬২ সালে সামরিক শাসন তুলে নেয়া হলে ছাত্রসমাজ অধিকার আদায়ের দাবিতে পুনরায় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। এ সময় শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশের গুলিতে ১৭ সেপ্টেম্বর ওয়ালিউল্লাহ, মোস্তফা কামাল ও বাবুল নামে কয়েকজন নিহত হন। ছাত্রসমাজের ২২ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে ১৭ সেপ্টেম্বর ’৬৩ ‘শিক্ষা দিবস’ পালন উপলক্ষ্যে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলসমূহ এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ ছাত্রদের এ আন্দোলনে সব ধরনের সমর্থন দিয়ে এগিয়ে আসে। এ সময় ছাত্রসমাজ গোপনে ছাত্রদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ এ ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। এ সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে পরিচিত ছিল।
১৯৬৫ সালে পাকভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলা সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত ছিল। এতে প্রমাণিত হয় পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ন্যূনতম উন্নতি করার চেষ্টা করেননি। বাঙালিদের প্রতি জাতিগত এ বৈষম্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে আহুত ‘সর্বদলীয় জাতীয় সংহতি সম্মেলন’ এ শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবী উত্থাপন করেন। পরবর্তীতে এ ছয় দফা দাবী বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের এক প্রচেষ্টা চালায়। সংগঠনের কোন এক সদস্যের অসতর্কতার ফলে পাকিস্তান সরকারের কাছে এ পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকার সামরিক বেসামরিক ২৮ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। ১৯ জুন ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে এক রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে। এ মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে দেশব্যাপী সরকার বিরোধী আন্দোলন পূর্ণতা লাভ করে। এর ফলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইউব খান দেশে সামরিক শাসন জারি করে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহইয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এ গণ আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে আসাদুজ্জামান এবং ২৪ জানুয়ারি স্কুল ছাত্র মতিউর রহমান মৃত্যুবরণ করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত অবস্থায় বন্দী আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক মৃত্যুবরণ করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এতে গণ আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ পাকিস্তান সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন এবং ২২ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকলেই ঢাকা সেনানিবাস থেকে মুক্তি লাভ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল গণ সংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
২৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে সারা দেশে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও সামরিক সরকার গণ দাবীকে উপেক্ষা করার মত শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। এজন্য জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহইয়া খান সারা দেশে এক ব্যক্তি এক ভোটের নীতিতে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭০ এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে তফসিল ঘোষণা করা হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ৩১০ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের ম্যান্ডেট লাভ করে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ নির্বাচিত এ জন প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার জাতীয় নেতৃবৃন্দ এর প্রতিবাদে রুখে দাঁাড়ায়। শুরু হয় অধিকারের সংঘাত। জাতীয়তাবাদী এ আন্দোলনে ছাত্র ও যুব সমাজের অংশগ্রহণ জন সমাজকে আরও উৎসাহিত করে।
জাতীয় সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১ মার্চ ১৯৭১ দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সর্বস্তরের জনগণ একবাক্যে বঙ্গবন্ধুর এ আহবানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অচল করে তোলে। ২ মার্চ ’৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা প্রদর্শিত হয়। ৩ মার্চ ’৭১ এ রমনা রেসকোর্স ময়দানে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর পক্ষ থেকে ‘স্বাধীনতার ইসতেহার’ পাঠ করা হয়। পাকিস্তান সামরিক সরকার জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কোন সমাধান না দেয়ায় ৭ মার্চ ’৭১ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে এক দিকনির্দেশনামূলক ভাষণে সকল প্রকার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হতে আহবান জানান। এ জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ এ ঘোষণার মাধ্যমে সারাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এতে আরও বেপরোয়া হয়ে যায়। তারা ২৫ মার্চ কালরাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ গঠন করে রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাাঙালির উপর বর্বর আক্রমণ চালায়। হিংস্র পাকবাহিনী ঢাকার পিলখানা, ইপিআর হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অগ্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা প্রদান করা হয়। বাঙালি দুর্বার সংগ্রামের মাধ্যমে জেগে ওঠে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার এবং পরে আরও কয়েক হাজার সহযোগী সদস্য যোগদান করে। যুদ্ধের শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারাই পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে ব্যস্ত রাখে। এ সময় ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং তাদেরকে পোশাক, অস্ত্র ও যানবাহনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করে। এছাড়া নভেম্বরের পরে ভারত সরকার প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা শুরু করে। ভারত ও বাংলাদেশ সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ নামে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৫২ বছর অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্য কতটুকু সফল হয়েছে সে প্রশ্ন আজ আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কি শুধু কোনভাবে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন? নাকি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন? যে পরিমাণ ত্যাগ, ক্ষত আর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সে পরিমাণ অর্জন আমাদের হয়নি। রাজনৈতিক বিভেদ ও ধর্মীয় অনৈক্য আমরা এখনও দুর করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করে নতুন প্রজন্মের মাঝে বিভাজন সৃষ্টির অভ্যাস এখনও পরিত্যাগ করতে পারিনি। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি; কিন্তু দেশকে ভালোবাসেন এমন তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে বিভাজন সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয় নয়। অনেক খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা মনে করেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদদের একটি নির্ভেজাল তালিকা এখনও পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। যেটি করা হয়েছে সেটিও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হলো জনগণের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, জনগণের সম্পদকে সংরক্ষণ করা, জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার ও ন্যায় আচরণ করা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও সে লক্ষ্য এখনও ভুলণ্ঠিত। আজও বাংলাদেশকে একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোন ক্ষেত্রেই সততা, নিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়নতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জনগণের সম্পদ লুট করে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করছে। দেশপ্রেম ও সুশাসন না থাকার কারণেই মূলত এমনটি হয়েছে।
এরপরও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কম হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ—এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত কমিটি—সিডিপি এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এর থেকে অনেক বেশি তথা ১৬১০ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২.৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪.৮ ভাগ। বাংলাদেশ এখন ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে।


পরিশেষে বলতে পারি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ অনেক কিছু অর্জন করলেও কাঙ্খিত বাংলাদেশ এখনও অর্জিত হয়নি। তবে যেটুকু অর্জন হয়নি তার জন্য অনুশোচনা না করে দেশপ্রেমিক প্রত্যেক নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। আমাদেরকে দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগগ করতে হবে। কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ না করে তাদের মত দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত হতে হবে। ধর্ম—বর্ণ, ধনী—গরীব নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজ থেকে বেইনসাফি দূর করতে হবে। মানুষের উপর মানুষের যুলুম, শোষণ ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দূর করতে হবে। মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বাধীনতার চেতনাকে যেন কেউ কলঙ্কিত করতে না পারে সেদিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিতে হবে। কোন অপশক্তি যেন আমাদের স্বাধীনতাকে বিকৃত করতে না পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা—সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রত্যেক নাগরিককে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হবে।

ড. ফেরদৌস আলম ছিদ্দিকী

প্রাবন্ধিক

সম্পর্কিত

মন্তব্য বাদ দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বাধিক পঠিত