পত্রিকার পাতা খুলতেই এখন নানামুখী অপরাধের খবর আমরা দেখতে পাই। বিশেষ করে কিশোর অপরাধে সয়লাভ গোটা সমাজ। সন্তানের দ্বারা পিতা-মাতার খুন, বন্ধুর দ্বারা বন্ধু খুন, স্বামীর দ্বারা স্ত্রী খুন, স্ত্রীর দ্বারা স্বামীর খুন, ভাইয়ের দ্বারা ভাই খুন, এমনকি মায়ের কাছেও তার সন্তান নিরাপদ নয়। পারিবারিক শিক্ষার অভাবে প্রতিটি স্তরে নৈতিক অবক্ষয় বর্তমান প্রজন্মকে পঙ্গুত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । মানুষের জীবনে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সহনশীলতা, শিষ্ঠাচার, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, অনুপম চরিত্র গঠন, সৌজন্যতাবোধ, উন্নত মানসিকতা সর্বোপরি ভদ্রতা শেখার প্রাথমিক বিদ্যাপীঠ হলো ব্যক্তির পরিবার। কথায় আছে ‘আম যদি মিষ্টি হয় তাহলে আমের আটিও মিষ্টি হবে’। অর্থ্যাৎ আদর্শিক পরিবারের সন্তান আদর্শিক শিক্ষা পেয়ে অধিকাংশ ই সু-সন্তান হয়। আজকের নিবন্ধে ‘একজন মানুষের নৈতিক অবক্ষয় রোধে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চাইতেও পারিবারিক শিক্ষা কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে; একজন শিশুর সুস্থ বিকাশ সাধন, সর্বোপরি একজন শিশুকে কিভাবে আদর্শিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে আগামী দিনের সু-সন্তান হিসেবে তৈরি করতে পরিবার কতটুকু ভূমিকা রাখবে’ তা বিস্তারিত তুলে ধরছি-
শিশু মনোবিজ্ঞানী হাইম গিনেট বলেছেন- “শিশুরা হচ্ছে ভেঁজা মাটির মত, এর উপর যা কিছুই পতিত হয় তার ছাপই ফুটে ওঠে”। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন- “শিশুরা হচ্ছে বাগানের কাদা মাটির মত, তাদের কে খুব আদর সোহাগ দিয়ে যত্ন করতে হবে”। অর্থ্যাৎ কাদা মাটি বা ভেঁজা মাটিকে আপনি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে রূপ দিতে পারবেন। এটেল মাটি হওয়ার আগেই আপনাকে সতর্ক হতে হবে এবং শিশুদের বিকাশ সাধনে যথাসময়ে পরিচর্চা করতে হবে। তুরষ্কে একটি কথা প্রচলিত আছে- “কোন জাতিকে পরিবর্তন করতে হলে আগে সে জাতির শিশুদের মস্তিষ্কের(চিন্তাশক্তির) পরিবর্তন করতে হবে” কেননা আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। একজন শিশুর মানসিক ভিত্তি তার শৈশবেই স্থাপিত হয়। সেক্ষেত্রে শিশুর মানসিকতায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে পরিবার তথা পারিবারিক শিক্ষা। ছোটদের মানসিকতা ছোট থেকেই বিকশিত হয় সেক্ষেত্রে শিশু সময়ে শিশুদের মস্তিষ্কে যে সকল চিন্তা বা শিক্ষা প্রতিস্থাপিত হয় সে বড় হয়ে সে চিন্তাশক্তি তথা তার জ্ঞানের যে ভিত্তি তার মূলের বাহিরে যেতে পারেনা, গেলেও সংখ্যাটা খুবই নগণ্য যা উদাহরণ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।
একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক অধঃপতন রোধে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চাইতেও পরিবার কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। নৈতিক শিক্ষার সবচেয়ে বড় উৎস ধর্ম যা শিশু তার পরিবার থেকেই শিখে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষা অসম্পূর্ণ আর একজন শিশুর সার্বিক বিষয়ে তদারকি করা কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই পুরোপুরি সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র নির্দেশনা দিতে পারে কিন্তু নীতি নৈতিকতার মূল বীজ মূলত পরিবারেই বপন করা হয়। যে বীজের পরিচর্চা যত বেশি হবে সে বীজ ততবেশি ভালো ফল দিবে। তাই একজন শিশুর মাথায় সুন্দর চিন্তা সেট করার জন্য পরিবারে সুন্দর একটি পরিবেশ চলমান রাখা অতীব জরুরী। এই চিন্তা প্রতিটি বাবা মায়ের থাকলে এমনিতেই শিশুর নৈতিক অধঃপতনের জায়গাটা রোধ হয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা দ্বিতীয় ধাপ। শিশুকে এমনভাবে তৈরি করা উচিত যেন সে যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যাবে তখন যেন পরোক্ষভাবে তার মস্তিষ্কে এটা সেট থাকবে যে ‘কোনভাবেই নৈতিকতার অবক্ষয় করা যাবেনা’। এটা সত্য যে পারিবারিকভাবে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত খুব কম সংখ্যকের নৈতিক অধঃপতন হয়। পরিবারে নৈতিক শিক্ষা না দিয়ে কেউ যদি মনে করে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠান ই তার সন্তনকে নৈতিক করে তুলবে তাহলে তাকে হয়তো এই ভুল চিন্তার খেসারত দিতে হবে। বর্তমান সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিবেশ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে -নোংরা ছাত্র রাজনীতি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গুলোতে হানাহানি, খুন, টেন্ডারবাজি, র্যাগিং, সংস্কৃতি চর্চার নামে অসংস্কৃতির চর্চা, ছেলে মেয়েদের অবাধ মেলামেশা, আকাশ সংস্কৃতির সয়লাভ, মাদকাসক্তি ইত্যাদির কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে আদর্শ শিক্ষা তা পুন:প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন। শিশুকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি করানোর আগে যথাসম্ভব শিশুর পারিবারিক শিক্ষা সমৃদ্ধ করা উচিত।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নৈতিকতার কথা থিওরিটিক্যালি শুধু বইয়ে পড়ানো হয় কিন্তু পরিবারে একটি শিশু প্র্যাকটিকালি সেটার বাস্তবায়ন দেখে, তার পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে এবং তাকেও সেভাবে তৈরি করা হয়। একজন শিশু যখন আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে বা বুঝতে শিখে তখন তার প্রথম নির্দেশক/আদর্শ/আস্থা এককথায় তার মা, এরপর তার পরিবার। সে আসলে দেখে তার মা কিভাবে তার বাবার সাথে কথা বলে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা কিভাবে একে অপরের সাথে কথা বলে? আশেপাশের মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলে? সে শিশু সেভাবেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। সর্বোপরি একটি পরিবারে যে সংস্কৃতি চালু আছে একটি শিশু মূলত সেই সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। পরিবারে ভালোর চর্চা হলে ভালোতে অভ্যস্ত হবে আর অসুস্থ চর্চা থাকলে সেদিকেই ধাবিত হবে। সুতরাং একটি শিশু কি শিখছে? কতটুকু শিখছে? তা নির্ধারিত হয় পরিবার থেকেই।
শিক্ষিত হওয়ার জন্য যেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে অনুরূপভাবে সুশিক্ষিত হওয়ার জন্য পারিবারিক শিক্ষারও প্রয়োজন আছে। অনেকেই মানুষ পরিচয়ে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি কিংবা মাদরাসায় ভর্তি হয় দিনশেষে বস্তা ভর্তি সার্টিফিকেট নিয়ে বের হলেও একটা অংশ নিজেদের নৈতিক সত্ত্বা হারিয়ে অমানুষ হয়ে বের হয়। আর এরাই দুর্নীতি, অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতায় জড়িয়ে যায়। সন্তান জন্ম দেওয়া সহজ হলেও সন্তানদের আদর্শিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা সময়ের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয়। যা প্রতিটি বাবা মায়ের নৈতিক দায়িত্ব, আর এই দায়িত্ব পালনে অধিকাংশ পিতা মাতা ব্যর্থ হয় বলেই সমাজে এত অনিয়ম আর অপরাধের বিস্তার। একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে পরিবার থেকে সন্তানেরা নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে না বলেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এতো বেশি অনিয়ম। বস্তুবাদী সমাজ ব্যবস্থায় আমরা এখন এতোটাই আত্মকেন্দ্রিক যে সবাই শুধুমাত্র নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকি। অধিকাংশ শিক্ষিত বাবা মা চাকরি কেন্দ্রীক অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকায় নিজ সন্তানদের যথাযথ সময় দিতে পারছেন না। পরিবারের এক সদস্য অন্য সদস্যের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, ফলে আনুশকা, ঐশীর মত মত সন্তান তৈরি হচ্ছে, মা বাবাকে জবাই করে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না। সন্তানের মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠনের মূল কেন্দ্র পরিবার। যে শিশুর পারিবারিক শিক্ষা যত সমৃদ্ধ সে শিশুর নৈতিক মান তত সমৃদ্ধ। যেহেতু শিশুরা কাদা মাটির মত তাই এটেল মাটি হওয়ার আগেই তাদেরকে সুশিক্ষার আদলে তৈরি করুন। প্রবাদ আছে “কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস” সন্তানকে যথাসময়ে যথাযথ শিক্ষা দিতে না পারলে আপনিও বয়োবৃদ্ধকালে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিন। আপনার এই অবহেলার জন্য আপনাকেই অনুতপ্ত হতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেটের চাইতেও একজন মানুষের বিনয় বড় সম্পদ, তাই আপনার সন্তান কে বিনয়য়ী হওয়ার শিক্ষা দিন, বিনয়ী করে তুলুন। সন্তানের প্রতি যত্নশীল হোন, আদর্শ জাতি গঠনে ভূমিকা রাখুন, আর হে সতর্ক হোন বিপদ আসার আসে।
–লেখক, মুহাম্মদ মেহেদী হাসান
প্রভাষক, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা