25 C
Dhaka
Wednesday, December 6, 2023
বাড়িপ্রবন্ধহ্যালোইন সংস্কৃতির গোড়ার কথা

হ্যালোইন সংস্কৃতির গোড়ার কথা

র্তমান বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বিভীষিকার রূপ পরিগ্রহ করেছে। মুসলিম দেশগুলোতে যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্বের অভাবে বা বিলাসী ও দুর্নীতিপরায়ন শাসকদের কারণে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বৃটিশ আমল থেকে এদেশে অপসংস্কৃতি স্থায়িত্ব লাভ করে। পাকিস্তান আমলের নেতৃবৃন্দও ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি তেমন কোন নজর দেননি। ফলে এদেশে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আমদানিকৃত কমিউনিজম আকিদা বিস্তার লাভ করে। কমিউনিজমের আকিদা সম্বলিত লাল বই এদেশের শিশুদের উপরও প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশ আমলে পূর্বের আমলের জের ধরে সাংস্কৃতিক ধস আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে ইসলামকে পরিকল্পিতভাবে নির্বাসনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়। ইসলামিয়া কলেজের নাম পরিবর্তন করে ‘কবি নজরুল কলেজ’ করার মাধ্যমে ইসলাম বিতাড়নের অভিযান শুরু করা হয়। শিক্ষার মনোগ্রাম থেকে ‘রাব্বি যিদনী ইলমা’ মুছে ফেলা হয়। সামরিক শাসকদের আমলে প্রদর্শনী আর মেলার নামে উন্মাতাল নগ্ন নৃত্য আর জুয়াড়ীদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা বৈধ করা হয়। পতিতা শিল্পের উন্নতি সাধিত হয়। শিখা অনির্বাণ নামে অগ্নিপূঁজার বিস্তার ঘটে। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হলেও ইসলামী সংস্কৃতির উপর আক্রমণের ধারা অব্যাহত থাকে এবং বর্তমানে এটি পশ্চিমা আর হিন্দু সংস্কৃতির দাপটে লণ্ডভণ্ড। হ্যালোইন সংস্কৃতি পশ্চিমা সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অত্যন্ত সুকৌশলে এটি মুসলিম দেশগুলোতে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে।

হ্যালোইন বিশ্বের প্রাচীনতম উৎসবের মধ্যে অন্যতম। এটি মূলত খ্রিস্টানদের একটি ধর্মীয় উৎসব। প্রতিবছর ৩১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা এ উৎসব পালন করলেও উন্নত বিশ্বে এ উৎসব প্রায় সার্বজনীন উৎসব হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। গ্রীষ্মের বিদায় ও শীতের শুরুর প্রথম দিনে প্রাচীন নানা আচার—অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে এর আয়োজন করা হয়। ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান ধর্মে শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজি Hallow শব্দ থেকে Halloween শব্দের উৎপত্তি। একে All Halloween, All Hallows Eve এবং All Saints Eve নামেও অভিহিত করা হয়। ঐধষষড়বিবহ অর্থ ‘শোধিত সন্ধ্যা’ বা ‘পবিত্র সন্ধ্যা’। এটি স্কটিশ ভাষার শব্দ All Hallows Eve  থেকে এসেছে। স্কটে ব্যবহৃত ‘ইভ’ শব্দটি সংকুচিত হয়ে ‘ইন’ হয়েছে। এভাবে সময়ের পরিবর্তনে Hallows Eve শব্দটি Halloween এ রূপান্তরিত হয়। All Hallows শব্দটি ইংরেজিতে পাওয়া গেলেও ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের পরে এটি আর ব্যবহৃত হয়নি।

মধ্যযুগে প্যাগান মঠের সন্ন্যাস—সন্ন্যাসীরা বছরের ৩১ অক্টোবর তারিখ বিগত বছরের পাপ কালিমা স্খালনের জন্য একটি উৎসবের আয়োজন করতো। এ উৎসব ছিল ‘পবিত্র হয়ে পবিত্র গণ্য হবার উৎসব’। অনেক পণ্ডিত মনে করেন, হ্যালোইন হলো খ্রিস্টানদের একটি বার্ষিক উৎসব যেটি প্রাথমিকভাবে কেলটিক ফসল কাটার উৎসব দ্বারা প্রভাবিত। কেউ কেউ মনে করেন, উৎসবটির স্বতন্ত্র উৎপত্তি সামহেইন থেকে এবং এর মূলে সরাসরি খ্রিস্টধর্মের প্রভাব বিদ্যমান। আইরিশরা ঐদিন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে বন্যোৎসব পালন করতো। তারা মনে করতো পাহাড়ের চূড়ায় বিরাট অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করলে জ্বীন—ভূত তাদের এলাকা থেকে পালাবে। জ্বীন—ভূত না থাকলে তাদের এলাকার মানুষ ও মাটি পবিত্র হয়ে উঠবে। তাই তারা আগুন জ্বালিয়ে ভূত তাড়াতো। তাদের পশুপাল চারণভূমি থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তনের তারিখও ছিল ৩১ অক্টোবর। হ্যালোইন উৎসবের দিন রায়তী স্বত্ব এক বছরের জন্য নবায়ন হত। তাদের এ বিশ্বাস ছিল যে, হ্যালোইন উৎসবের দিন মৃতদের আত্মা স্ব স্ব আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে এবং বাড়িঘরের হাল অবস্থা দেখে চলে যায়।

প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন কারা এই কেল্টিক? কেল্ট নামে ইন্দো—ইউরোপীয় একটি জাতি ছিল। লৌহযুগের সময়কালে এরা পৃথিবীতে বসবাস করতো। বর্তমানে পৃথিবীর আয়ারল্যান্ড ও ফ্রান্সের উত্তরাংশে কেল্ট জাতির গোড়াপত্তন হয়েছিল। তারা বহু ইশ্বরবাদে বিশ্বাসী ও মূর্তিপূজক ছিল। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জী দিয়ে হিসাব করলে দেখা যায়, কেল্টিকদের বছর শেষ হতো ৩১ অক্টোবর তারিখে এবং বছর শুরু হতো নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে। নভেম্বরের ১ তারিখকে ধরে নেয়া হতো গ্রীষ্মের শেষ এবং শীতকালের শুরু। কেল্টিকরা শীতকালকে ভয় পেত। কারণ এসময় ফসল উৎপাদিত হতো না। শীতকাল তাদের জন্য ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন ও ভয়ের। কেল্টিকরা বিশ্বাস করতো নতুন বছরের আগের রাতে তথা ৩১ অক্টোবর তারিখে ওপার জগত ও এপার জগতের মধ্যে পর্দা সংকুচিত হয়ে যায় এবং মৃতদের সাথে এ দুনিয়ার মানুষদের সংযোগ ঘটে। এজন্য ৩১ অক্টোবর সূর্য ডুবে যাওয়ার পরপরই কেল্টিকরা সামহেইন (Samhain) নামে একটি উৎসব করতো, যেটি ১ নভেম্বর সূর্যাস্ত পর্যন্ত স্থায়ী হতো।

হ্যালোইন উৎসবের অন্য একটি উদ্দেশ্য ছিল এই যে, ভূত—প্রেত, দৈত্য—দানব আর পরীরা প্রতিবছর অক্টোবরের ৩১ তারিখ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিভিন্ন লোকালয়ে হানা দিয়ে মানুষের প্রচুর ক্ষতি করতো। ঠিক এ সময়ে ভ্রাম্যমান দৈত্য—দানবদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তারা পরের বছর দ্বিগুণ ক্ষতি সাধন করবে। তাই তারা উৎসবের আয়োজন করে ভূত তাড়াবার ব্যবস্থা করতো এবং মৃত আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতো। এ উৎসব উদযাপনের আরও একটি কারণ ছিল বিবাহ, সৌভাগ্য, উন্নত স্বাস্থ্য ও মৃতের আত্মার সদগতির জন্য প্রার্থনা করা।

হ্যালোইন উৎসবের প্রাক্কালে যে মূল ধারণা বা থিম অনুসরণ করা হয়, তা হলো ‘হাস্যরস ও উপহাসের সাহায্যে মৃত্যুর ক্ষমতার মুখোমুখি হওয়া’। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে অক্টোবর মাস শুরু হলেই বিভিন্ন দোকানে হ্যালোইন উৎসবের জন্য সাজ সাজ ভাব শুরু হয়ে যায়। মিষ্টি কুমড়া থেকে শুরু করে কালো রঙের পোশাক, মাকড়সার জাল, ভূত সাজার মুখোশ ইত্যাদি আনুষাঙ্গিক হরেক রকমের জিনিসপত্র বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এ উৎসবে পালিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে ‘ট্রিক অর ট্রিট’ বা কৌশল নয়তো আপ্যায়ন, ‘বনফায়ার’ বা অগ্ন্যুৎসব, আজব পোষাকের পার্টি, ভৌতিক স্থান ভ্রমণ, ভয়ের চলচ্চিত্র দেখা ইত্যাদি। ধীরে ধীরে হ্যালোইন উৎসবের আকৃতি—প্রকৃতির মধ্যে নানা পরিবর্তন ঘটতে থাকে। খ্রিস্টান জগত এ অনুষ্ঠানকে বাঁধনহারা আনন্দ স্ফুর্তির উৎসব হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। স্কটল্যান্ডের কিশোর কিশোরীরা হ্যালোইন উৎসব উদযাপন করতো তিনটি কারণে।

  • প্রথম কারণ: এ উৎসব চলাকালীন ভোগের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার অপূর্ব সুযোগ ছিল।
  • দ্বিতীয় কারণ: কে কত বিচিত্র পোশাক পরিধান করতে পারে এর প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা হতো।
  • তৃতীয় কারণ: কে কাকে স্ত্রী বা স্বামী হিসেবে পেতে চায়, সেটি এ উৎসবে বেছে নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ ছিল।

৩১ অক্টোবর দিনের আলো শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। সবার গায়ে থাকে অদ্ভুতুড়ে কস্টিউম এবং হাতে থাকে টর্চ। বাসায় বাসায় গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে ট্রিক অর ট্রিট। যদি কেউ ট্রিক বেছে নেয়, তাহলে তাকে কিছু করতে হবে; না হলে তাকে ট্রিট দিতে হবে। আজকের দিনে কেউই অবশ্য ট্রিক করতে চায়না। সবাই ট্রিট হিসেবে চকলেট কিংবা লজেন্স প্রদান করে। আর সেই চকলেট কিংবা লজেন্স নেয়ার জন্য ছোট ছেলেমেয়েরা ব্যাগ নিয়ে বের হয়।

আমেরিকায় ট্রিক কিংবা ট্রিটিংয়ের হ্যালোইন ঐতিহ্য সম্ভবত ইংল্যান্ডের প্রথম দিকের ‘অল সোলস ডে প্যারেডের’ সময়কার। এর অর্থ উৎসব চলাকালে দরিদ্র নাগরিকরা খাবার ভিক্ষা চাইবে এবং সচ্ছলরা তাদের পরিবারের না ফেরার দেশে যাওয়া স্বজনদের জন্য প্রার্থনা করার প্রতিশ্রম্নতির বিনিময়ে তাদের ‘সোল কেক’ বা আত্মার কেক নামক পেস্ট্রি দেবেন। ঘুরে বেড়ানো আত্মাদের জন্য খাদ্য ও ওয়াইন ত্যাগের প্রাচীন অভ্যাসের মাধ্যমে গীর্জাগুলো ‘সোল কেক’ বিতরণে উৎসাহিত করেছিল। এ চর্চাকে ‘আত্মা প্রাণে যাওয়া’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। অবশেষে শিশুদের মাধ্যমে এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এসব শিশু তাদের প্রতিবেশীদের বাড়িগুলো ঘুরে বেড়ায় আর তাদের বিশেষ পানীয়, খাবার ও অর্থ দেয়া হয়।

হ্যালোইন উৎসব উদযাপন অনেক তরুণীকেই তাদের ভবিষ্যৎ স্বামী বেছে নিতে সাহায্য করেছিল। তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, তারা একদিন ভাগ্য নিয়ে আসবে এবং পরের হ্যালোইনের মধ্যে তাদের বিয়ে হয়ে যাবে। আঠারো শতকে আয়ারল্যান্ডে একজন রাঁধুনি হ্যালোইনের রাতে সিদ্ধ করা আলুতে একটি আংটি পুঁতে রাখেন এ আশায় যে, এটি খঁুজে পাওয়ার মধ্য দিয়ে তার সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া যাবে। স্কটল্যান্ডের জ্যোতিষীরা সুপারিশ করেছিল, বিবাহযোগ্য তরুণীরা প্রত্যেকের জন্য একটি হ্যাজেলনাটের নাম রাখবে এবং সেগুলো অগ্নিকুণ্ডে ফেলে দিবে। যেটি না ফুটে বা বিস্ফোরিত না হয়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, ঐ নামের ব্যক্তি তরুণীর ভবিষ্যতের স্বামী হবে। অন্য একটি গল্পে বলা হয়েছে, হ্যালোইনের রাতে ঘুমানোর আগে যদি একজন তরুণী আখরোট, হ্যাজেলনাট ও জয়ফল দিয়ে তৈরি চিনিযুক্ত খাবার খেয়ে থাকে তাহলে সে তার ভবিষ্যৎ স্বামীর স্বপ্ন দেখবে।

আইরিশ ও স্কটিশ অভিবাসীরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে হ্যালোইন উৎসব উত্তর আমেরিকাতে নিয়ে আসে। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আমেরিকায় নতুন অভিবাসীদের জোয়ার শুরু হয়। এসব নতুন অভিবাসীদের মধ্যে লাখো আইরিশ দুর্ভিক্ষের কারণে পালিয়ে আসে। ধীরে ধীরে জাতীয়ভাবে হ্যালোইন উদযাপনকে জনপ্রিয় করতে তারাই সাহায্য করে। প্রথমে ফসল কাটা উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এসব অনুষ্ঠানে প্রতিবেশীরা নিজের ভাগ্য নিয়ে কথা বলতো, নাচতো ও গান করতো। এছাড়া এসময় হ্যালোইন উৎসবে ভূতের গল্প বলা এবং বিভিন্ন ধরনের দুষ্টুমি করা হতো।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে হ্যালোইন উৎসব খ্রিস্টান জগতে এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এ সময় ঐ দিনকে দুষ্কৃতিপরায়ণ কিশোর কিশোরীরা চরম উচ্ছৃঙ্খলতা প্রদর্শনের দিবস হিসেবে গ্রহণ করে। এরা ঐ দিন যা ইচ্ছা তাই করতে পারতো। ইট পাথর নিক্ষেপ করে বাড়িঘরের ক্ষতি করলেও কেউ কোন প্রতিবাদ করতোনা। কয়েক বছর এ অবস্থা চলে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো এ উৎসব উদযাপন শুরু করে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, পুয়ের্তোরিকো এবং যুক্তরাজ্য। এছাড়া এশিয়ার জাপানে এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও এ উৎসব পালন করা হয়। এসময় হ্যালোইন উৎসবের ধারা পরিবর্তন হতে থাকে। শুধু শিশুরা ঐ দিনকে পালন করতে থাকে। তারা ঐ দিন দলে দলে দ্বারে দ্বারে গান গেয়ে উৎসবের খরচ সংগ্রহ করতো। বর্তমানে এ উৎসব বড়দের দখলে চলে গেছে। বাচ্চাদের মধ্যে এটি শুধু এখন তামাশা করার দিন। এ উৎসব এখন পবিত্র করা বা হওয়ার কোন উৎসব নয়। বর্তমানে নগ্নতা হচ্ছে এ সংস্কৃতির মূল উপজীব্য বিষয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন রীতিতে হ্যালোইন উদযাপন করে যাচ্ছে। ম্যাকি্্রকোতে দিনটি ‘ডে অব দ্য ডেড’, চীনে ‘টম্ব সোয়েপিং ডে’ হিসেবে পালিত হয়। ইউরোপ—আমেরিকায় রাতটি উদযাপনের জন্য মাসব্যাপী প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। এ উৎসবে আমেরিকানরা বার্ষিক আনুমানিক ৬০০ কোটি ডলার খরচ করে। বড়দিনের পর সবচেয়ে বেশি আয় হয় এ উৎসব থেকে। বাজারে দেখা যায় বিশেষ কোন পোশাক বা কস্টিউমের দোকান। কোথাও ডাইনি, কোথাও জলদস্যু, ভাম্পায়ার, স্পাইডারম্যান, জম্বি এবং ব্যাটম্যানসহ বিভিন্ন পোশাকের বিক্রি বেড়ে যায় হ্যালোইন উপলক্ষ্যে।

১৯৬৫ সাল থেকে ইউনিসেফের উদ্যোগে হ্যালোইন উৎসব প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হয়ে আসছে। চিলড্রেন ফান্ড সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই এ সংস্থা এটি করে থাকে। ইউনিসেফ খ্রিস্টান বা প্যাগানদের কোন প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের সব ধর্মের, সব মতের ও সব বর্ণের মানুষ নিয়েই এর সকল কর্মতৎপরতা। জাতীসংঘভুক্ত দেশসমূহে কেবল খ্রিস্টানই বাস করেনা, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও বাস করে। কাজেই ইউনিসেফ শুধু খ্রিস্টানদের একটি অনুষ্ঠানকে ফোকাস করতে পারে না। এক্ষেত্রে ইউনিসেফকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা উচিত।

বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরেই হ্যালোইন উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। ১৯৮২ সালের ৪ নভেম্বর হোটেল সোনারগাঁয়ে জাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠিত হয় হ্যালোইন উৎসব। এটি বন্ধ করার জন্য কোর্টে রীট করা হয়েছিল। কোর্ট এ ব্যাপারে ইনজাংশন জারীও করেছিল, কিন্তু সোনারগাঁও হোটেল কতৃর্পক্ষ আদালতকে পাশ কাটিয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ৪ নভেম্বর রাত ৮টা থেকে ৫ নভেম্বর বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ অনুষ্ঠান স্থায়ী ছিল। খ্রিস্টানদের অনুষ্ঠান হলেও এতে মুসলিম যোগদানকারীর সংখ্যাই বেশি ছিল। ২১ ঘন্টার একটানা এ অনুষ্ঠানে কি হয়েছিল তা আমাদের জানা থাকা দরকার। একটি মুসলিম দেশ এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে কি না সেটি ভেবে দেখা দরকার। একজন প্রয়াত লেখক ঐ অনুষ্ঠানের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ঐ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা ‘লীন’ হয়ে গিয়েছিল। কারো কারো নিজেদের অস্তিত্বের খবর পর্যন্ত ছিলনা। আনন্দের সায়রে হাসি গান আর বিচিত্র কৌতুক রসের ঢেউ তুলে ‘লেডিজ—লেডাজ’ মনের সুখে সাঁতার কেটেছেন, ডুব দিয়েছেন, ঢেউ কেটে কেটে রাজহাঁসের মত ভেসে ভেসে হেসে হেসে মধু যামিনী যাপন করেছেন। কার খালু কোথায় গেছেন, কার আন্টি কোন আন্টার্কটিকায় হারিয়ে গেছেন, কার ভাবী কার আংকেলের বুকে ঠাঁই নিয়েছেন তার দিশা—বিশা ছিল না’।

বর্তমানে রাজধানীতে হ্যালোইন উৎসব একটি ভুতুড়ে দিবস হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি বা মুসলিম সংস্কৃতি না হলেও দিন দিন এ উৎসব পালনের প্রতি শিশু কিশোরদের ঝোক বেড়ে যাচ্ছে। এ দিবসকে সামনে রেখে কোন কোন অভিনেত্রী হ্যালোইন সাজে সেজেছেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটি মুসলিম দেশের নাগরিক হয়েও আমরা এ ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি, অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। এটি আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়। আমাদের সংস্কৃতির এ করুণ অবস্থা দুর করতে হবে। মুসলিম সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে। পশ্চিমের যে স্রোতে তরুণ সমাজ মোহাবিষ্ট হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে, ঠিক এর বিপরীত স্রোত সৃষ্টি করতে হবে। হ্যালোইন নিয়ে মাতামাতি, হুড়োহুড়ি ও লাফালাফি বন্ধ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা গ্রহণের। পাশাপাশি সরকারকে নিজস্ব সংস্কৃতির হিফাযত, লালন পালন, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক ও আগ্রহী হতে হবে। আমীন!

লেখকঃ ড. ফেরদৌস আলম ছিদ্দিকী

 

সম্পর্কিত

মন্তব্য বাদ দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বাধিক পঠিত