২ অক্টোবর, জাতীয় পথ শিশু দিবস। আমাদের দেশে পথ শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই দিবস প্রতিবছর পালিত হয়। ফলে পথশিশুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মায়ের কোল হলো তাদের নিরাপদ আশ্রয়। ক্ষুধার জ্বালায় মায়ের কোল ছেড়ে শিশুরা যখন মা-বাবার ঘর ছেড়ে অজানার পথে পা বাড়ায় তখনই তাদের পরিচয় হয় পথ শিশু। মানুষের মানবতা এবং মনুষ্যত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। শিশু কখনোই পথশিশু হয়ে জন্মায় না। যত ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে শিশুরা, তার সবই আছে পথশিশুদের৷ তাদের অধিকারের জায়গা থেকে, বঞ্চনার জায়গা থেকে, সব ধরনের ঝুঁকিতে থাকা শিশুরাই আমাদের পথশিশুরা৷ ছিন্নবস্ত্র পরিহিত বা বস্ত্রহীন এরাই পথশিশু নামে সর্বত্র পরিচিত।
একটা শিশুর সবার আগে অধিকার রয়েছে বাসস্থানের, নিরাপত্তার অধিকার – খাদ্যের অধিকার – শিক্ষার অধিকার৷ কিন্তু এর কোনো অধিকারই তারা পাচ্ছে না; তার ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি থাকছে রাস্তা-ঘাটে৷ তাদের ওপর অর্থনৈতিক নিপীড়ন থাকছে; শক্তিশালী সিন্ডিকেট তাদেরকে দিয়ে জোর করে ভিক্ষাবৃত্তি করায়; অঙ্গহানি করে তাদেরকে চিরস্থায়ী পঙ্গু করে দেয়। এবং এর চেয়েও বেশি পরিমাণে যেটা, সেটা হচ্ছে মাদক এবং নানা ধরনের যৌন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে শিশুদের জোর করে জাড়ানো হচ্ছে, যেটা ক্রমশ তাদেরকে ‘হিউম্যান বম্বে’ পরিণত হচ্ছে৷ ফলে সার্বিকভাবেই ভয়াবহ থেকেও ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পথশিশুরা রয়েছে৷ এসব কিছুই কিন্তু পথশিশুদের জন্য প্রযোজ্য বাস্তবতা৷ যখন অন্য শিশুরা পাঠশালায় জ্ঞান অন্বেষণে ব্যস্ত তখন এরা নিজেদের পেটের ক্ষুধা মেটাতে জনে জনে হাত পাতে, লাথি খায়।
সর্বশেষ জরিপে ১২ লাখ আশি হাজারেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত৷ আমরা কেবল তাদের ওখানে নজর দিচ্ছি যে, এই বারো লাখ আশি হাজার শিশুকে সরিয়ে নিরাপদে নিয়ে যেতে পারি কিনা৷ কিন্তু আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে, নতুন করে যেন কোনো শিশু সেই জায়গায় না আসে৷ সেই ধরনের প্রতিরোধমূলক কাজটা যদি বাড়ানো যায়, তাহলে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশও গড়া সম্ভব৷
শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে সরকার৷ কিন্তু সব পথশিশু স্কুলে যাচ্ছে না৷ তাদের শিক্ষার মধ্যে আনার পথে প্রতিবন্ধকতা কী? আমরা এর আলোকে দেখি বাধ্যতামূলক শিক্ষা, মানে পথশিশুটিকে যদি তিন ঘণ্টার জন্য বা চার ঘণ্টার জন্য স্কুলে আসতে বলা হয়, তাহলে তাকে তো পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে আসতে হবে৷ পেট ভরে খেয়ে আসতে হবে৷ এখন দেখেন তার থাকার জায়গা নেই, ভালো একটা কাপড় নেই, খাবারের কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ তার জন্য পড়তে আসা বাধ্যতামূলক করা কতটা বাস্তবসম্মত? তার জন্য সেখানে শিক্ষার অবস্থান অনেক নীচেই৷
সারাদেশেই শিশুদের ভিতরে নানা রকম পর্নো বা অশ্লীল কন্টেন্টগুলো প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে৷ ঢাকা শহরে ক্লাস এইট থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত ৭৭ শতাংশ ছেলেরা ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি দেখে৷ এটা থেকে উত্তেরনে একটা সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন রয়েছে৷ পাশাপাশি সুস্থ এবং বিজ্ঞানসম্মত যৌন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে৷ এটা নিয়ে আমরা কথা বলি না৷ কিন্তু ঠিকই প্রত্যেকটা শিশু বড় হচ্ছে৷ যখন সে কৈশোর পার হয়, তখন নানা জায়গা থেকে যৌনশিক্ষা লাভ করে এবং সেটি অধিকাংশ সময় ভুল এবং ভয়ঙ্কর রকমের বাজে পথে তাদেরকে নিয়ে যায়৷ কাজেই সুস্থ যৌনশিক্ষা এবং পাশাপাশি শিশুদের যদি খেলাধুলাসহ নানা রকমের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে পারি, তাহলে তাদের পর্নোগ্রাফি থেকে মুক্ত করা সম্ভব৷
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সূত্র মতে, ঢাকা বিভাগে মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে। মাদকাসক্ত ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে এবং মেয়ে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এদের সঠিক তদারকি না করা হলে তারা ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
মানবতার বিকাশ এবং জাতির বৃহত্তম স্বার্থে পথ শিশুদের শিক্ষা আবশ্যক। সচেতন থাকতে হবে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে এরা যেন অল্প বয়সেই হারিয়ে না যায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানহীন শিশুরা যেন পরবর্তীকালে জাতির কাঁধে বোঝা না হয়ে বসে সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা সকলেরই উচিত। পথ শিশুদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব শিশুর রয়েছে সমান অধিকার।
প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো পিতৃহীন শিশুকে আশ্রয় দিয়ে নিজের পানাহারের মধ্যে শরিক করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, তবে সে যদি ক্ষমার অযোগ্য কোনো অপরাধ না করে, যথাঃ আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে অথবা বান্দার হক নষ্ট করে, তাহলে ভিন্ন কথা (মুসনাদে আহমদ)। শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রিয় নবী (সা.) যেমন সদা সজাগ ও সচেতন ছিলেন তেমনি সে আদর্শ অনুসরণে আমাদেরও আন্তরিক হতে হবে এই হোক পথ শিশুদিবসে আমাদের অঙ্গীকার।
আব্দুর রহিম
– লেখক
সম্পাদক
দ্যা ক্যাম্পাস মিরর