25 C
Dhaka
Wednesday, December 6, 2023
বাড়িস্বাস্থ্যকথাআপনি কি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিমুক্ত?

আপনি কি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিমুক্ত?

বিশ্বে প্রতি ৭ সেকেন্ডে ১ জন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতি মিনিটে মারা যাচ্ছে ২ জন। অর্থাৎ বছরে এ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ১০ লক্ষের বেশি। বর্তমান পৃথিবীতে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫৩ কোটি ৭০ লক্ষ, যা ২০৪৫ সাল নাগাদ ৭৮ কোটি ৩০ লক্ষে পৌছাবে। (WHO’2022)

ডায়াবেটিস কি?

আমরা যে খাবার গ্রহণ করি তার অধিকাংশ লিভারের মাধ্যমে মেটাবলিজম হয়ে গ্লুকোজ/সুগারে পরিনত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। অগ্ন্যাশয় থেকে আগত ইনসুলিন নামক হরমোনের সহযোগীতায় রক্তে থাকা গ্লুকোজ শরীরের প্রতিটি কোষে প্রবেশ করে শক্তি (ATP) উৎপন্ন করে। এ শক্তি ব্যাবহার করে কোষ তথা মানবদেহ সচল থাকে। কিন্তু অগ্ন্যাশয় যদি পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন করতে না পারে অথবা ইনসুলিন থাকা সত্বেও যদি গ্লুকোজ কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশে বাধা পায় তাহলে রক্তে গ্লুকোজ জমতে থাকে এবং স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এই অবস্থাকে বলা হয় ডায়াবেটিস।

ডায়াবেটিস কি ধরণের রোগ?

এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা একবার হলে আর কখনোই পুরোপুরি সেরে যায়না। তবে যথাযথ চিকিৎসা ও নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

তরুন বয়সে কি ডায়াবেটিস হয়?

শিশু থেকে বৃদ্ধ, সকল বয়সেই ডায়াবেটিস হতে পারে।

ডায়াবেটিস কত প্রকার?

এটি প্রধাণত ২ প্রকার। টাইপ-১ ডায়াবেটিস ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস। এছাড়াও জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস ও অন্যান্ন কিছু ডায়াবেটিস রয়েছে।

টাইপ-১ ডায়াবেটিসঃ শিশুরা এ ডায়াবটিসে আক্রান্ত হয়। অগ্ন্যাশয় পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদনে ব্যার্থ হলে অর্থাৎ শরীরে ইনসুলিন তৈরি না হলে সেই অবস্থাকে টাইপ-১ ডায়াবেটিস বলে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত ইনসুলিন গ্রহণ করতে হয়। মোট রোগীর ১০ শতাংশ টাইপ-১ এ আক্রান্ত।

টাইপ-২ ডায়াবেটিসঃ এটা যেকোন বয়সেই হতে পারে। গ্লুকোজ শরীরের কোষে প্রবেশ করতে না পারলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়তে থাকে। এই অবস্থাকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বলে। সুশৃঙ্খল জীবন ও সচেতনতার মাধ্যমে এটা প্রতিরোধ এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসঃ গর্ভবতী মায়েরা গর্ভাবস্থায় এ ধরণের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে মা ও শিশু উভয়ই ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। মাতৃগর্ভ থেকেই শিশু ডায়াবেটিস নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে।

ডায়াবেটিসের কারণ কি?

জেনেটিক্যালঃ যাদের পরিবারে বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানীর ডায়াবেটিসের ইতিহাস রয়েছে তাদের ডায়াবেটিসের ঝুকি সবচেয়ে বেশি।

জীবনযাত্রার মানঃ হাটাচলা বা শারীরিক পরিশ্রম কম করা, মানসিক চাপ, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, রাতে জেগে থেকে দিনে ঘুমানো, ওজন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ।

খাদ্যাভ্যাসঃ রাতে বেশি খাওয়া, সকালে নাস্তা না করা, ধূমপান, মদ্যপান, চাইনিজ, বার্গারসহ উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ ডায়াবেটিসের জন্য ঝুকিপূর্ণ।

এগুলো ছাড়াও কিছু পরিবেশগত কারণ রয়েছে। যেমনঃ দক্ষিণ এশিয়াতে ডায়াবেটিসের প্রবণতা বেশি।

ডায়াবেটিস কিভাবে প্রতিরোধ করবেন?

সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করার মাধ্যমে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা সম্ভব। অক্ষয় কুমার থেকে এলন মাস্ক, পৃথিবীর সকল সফল মানুষের সফলতা, সুস্থতা ও উচ্চ কর্মক্ষমতার অন্যতম কারণ তাদের সচেতনতা ও সুশৃঙ্খল জীবন।

  • নিয়মিত ৩০-৪৫ মিনিট হাটার অভ্যাস করুন, ব্যায়াম করুন, শারীরিক পরিশ্রম বাড়ান, দীর্ঘ সময় শুয়ে-বসে থাকা হতে বিরত থাকুন।
  • পর্যাপ্ত ঘুমান, রাত ১১ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস করুন, ভোরে উঠে পড়ুন।
  • বাইরের খবার, অতিরিক্ত তৈল-চর্বি যুক্ত খাবার, অস্বাস্থ্যকর খাবার, ভাজাপোড়া, জাংক ফুড পরিহার করুন। খাবারে শাক-সবজির পরিমান বাড়ান।
  • মদ্যপান ও ধুমপান থেকে বিরত থাকুন। এগুলো ডায়াবেটিস ছাড়াও আরো অনেক রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
  • প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলুন।
  • মানসিক চাপমুক্ত থাকুন। আপনার জীবন কখনোই পুরোপুরি সমস্যামুক্ত হবেনা। তাই সকল কিছুর মধ্যেই স্বাভাবিক থাকতে শিখুন। দুশ্চিন্তা না করে ঠান্ডা মাথায় সমাধান করুন। বুদ্ধিমত্তার সাথে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের অভ্যাস গড়ে তুলুন।

ডায়াবেটিসের লক্ষণ সমূহ কিঃ

  • খুব তৃষ্ণা পাওয়া।
  • স্বাভাবিকের চাইতেও ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া। বিশেষ করে রাতের বেলায়।
  • দুর্বল ও ক্লান্ত বোধ করা।
  • কোন কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া।
  • প্রদাহজনিত রোগে বারবার আক্রান্ত হওয়া।
  • দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া।
  • শরীরের কোথাও কেটে গেলে বা যেকোন ক্ষতস্থান শুকাতে দেরি হওয়া।
  • চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে ও চুলকানি ভাব।
  • বিরক্তি ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠা।
  • ক্ষুধা বেশি লাগা।

শরীরে এ ধরণের লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ডায়াবেটিস ছাড়াও আরো অনেক কারণেই এ ধরণের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তাই দুশ্চিন্তা না করে সঠিক পরীক্ষা করার মাধ্যমে নিশ্চিত হোন। সুস্থ থাকুন।

ডায়াবেটিস হওয়ার পর করনীয় কি?

শরীরে ডায়াবেটিস সনাক্ত হলে অবহেলা বা দুশ্চিন্তা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নিয়ম মেনে চলুন। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনুন। শুরুতে এমনটা মনে হতে পারে যে ডায়াবেটিস আপনার কোন ক্ষতি করছেনা। এটা ভেবে যদি অবহেলা করেন তাহলে ভবিষ্যতে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নিয়মিত ও সময়মতো খাবার গ্রহণ করুন। খাবারে শাক-সবজির পরিমান বাড়ান, ভাত বা কার্ভাইড্রেট কমান। মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিহার করুন। মাংস ও তৈল-চর্বি খাওয়া কমিয়ে দিন। সাদা আটার পরিবর্তে লাল আটার রুটি খান। একবারে বেশি না খেয়ে অল্প অল্প করে বারবার খাওয়া ভালো। পর্যাপ্ত ঘুমান। স্ট্রেস কমিয়ে দিন। নিয়মিত হাটার অভ্যাস করুন, শরীর চর্চা করুন। প্রতি সপ্তাহে ওজন ও রক্তের গ্লুকোজ পরিমাপ করুন। শরীরের পুষ্টির চাহিদা সঠিক উপায়ে পূরনের লক্ষ্যে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে পারেন।

ডায়াবেটিস হলে কি ধরণের ক্ষতি হতে পারে?

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস দীর্ঘদিন থাকলে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ অর্গান স্থায়ীভাবে ড্যামেজ করতে পারে। যেমনঃ

  • স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়ে যাও্য়া বা ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি।
  • কিডনী ড্যামেজ হয়ে যাওয়া বা ডায়াবেটিক নেফ্রপ্যাথি।
  • নার্ভ ড্যামেজ বা ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি। এর ফলে শরীরের নিচের অংশ কেটে ফেলার প্রয়োজন হয়।
  • হৃৎপিণ্ড (হার্ট) ও রক্তনালীর অসংখ্য রোগের জন্য দায়ী অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস।
  • ডায়াবেটিক ফুট। এর কারণে বিভিন্ন সময় পায়ের আঙ্গুল বা নিচের অংশ কেটে ফেলাতে হয়।
  • ক্ষতস্থান শুকাতে দেরি হয়। কখনো সেখানে পচন ধরে বা গ্যাংগ্রিন হয়। ফলে সেই অংশ কেটে ফেলতে হয়।
  • অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস চামড়া ও মুখে বিভিন্ন ধরণের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে।
  • জীবনের ব্যাপারে অবসাদ সৃষ্টি করে। কর্মক্ষমতা কমায়।
  • “এলজেইমার’স ডিজিজ” এবং মৃত্যু হতে পারে।

ডায়াবেটিস বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে কমন রোগ গুলোর একটি। দিন দিন এটি মহামারী আকার ধারন করছে এবং উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালন করা হয়। আসুন এখনই সচেতন হই। সকলে মিলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করি। সুস্থ থাকি। প্রিয় মানুষদের ভালো রাখতে চেষ্টা করি।

 

 

Dr. S. M. Mamun

MBBS, MPH

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
সম্পর্কিত

মন্তব্য বাদ দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বাধিক পঠিত