আমরা ইদানিংকালে খুব করে আত্মহত্যার কথা শুনে আসছি। কিছুদিন আগে আত্মহত্যা করার মেশিন আবিষ্কার হয়েছে তাও আমরা জেনেছি। ফেইসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা অথবা সুইসাইড নোট লিখে পৃথিবীকে বিদায় জানানোর খবরগুলো প্রায় নিয়মিতই শুনতে হচ্ছে। আমাদের অনেক পছন্দের নায়ক/ গায়কের আত্মহত্যার খবর শুনে আমরা খুব চমকে উঠি।
আত্মহত্যা নিয়ে অনেক বছর আগে থেকেই বিস্তর গবেষণা হয়ে আসছে। আশির দশক পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করতেন গভীর বিষণ্ণতা এবং অন্যান্য মানসিক রোগ যেমনঃ- সিজোফ্রেনিয়া, বাই-পোলার, মুড ডিসঅর্ডার ইত্যাদির সঙ্গেই শুধু আত্মহত্যা জড়িত। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ১০ শতাংশ আত্মহত্যার ক্ষেত্রে কোনো রকমের মানসিক রোগী জড়িত ছিল না। আমরা সাধারণত আত্মহত্যাকে শুধু ডিপ্রেশনের একটি লক্ষণ মনে করে থাকি। এটি আমাদের ভুল ধারণা।
আত্মহত্যা বলতে বোঝায় যখন কেউ তার জীবন শেষ করার অভিপ্রায়ে নিজের ক্ষতি করে। মানুষেরা যে কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করে তা ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন এবং জটিল; কিন্তু তারা প্রায়ই গুরুতর মানসিক ব্যথার সাথে জড়িত, যা একজন ব্যক্তি অসহনীয় বলে মনে করেন।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আত্মহত্যা দু’ধরনের হয়, ১.পরিকল্পিত এবং ২.আবেগতাড়িত।
মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা মতে,আত্মহত্যার কিছু রকম এবং কিছু ধাপ আছে৷
প্রথম ধাপঃ এ ধাপে রোগী নিজেকে পৃথিবীতে আর দেখতে চান না এবং ভাবতে থাকেন- আমি নিজে সক্রিয় হয়ে কিছু করব না, তবে মৃত্যু চলে এলে ভাল হয়।
দ্বিতীয় ধাপঃ এ ধাপে রোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তিনি কীভাবে মরতে চান এবং সেটা নিয়ে পরিকল্পনা করা শুরু করেন এবং খুব আগ্রহ নিয়েই কাজটি করতে থাকেন। সে মরে যাবার পর কোন কোন মানুষ তার জন্য কাঁদবে এরকম কিছু মানুষের চেহারা চিন্তা করতে তার ভাল লাগে। ছাদের উপর থেকে নিচের রাস্তায় নিজের থেঁতলানো শরীর কল্পনা করতে তার খুব ভয় লাগে। কখনো ধর্ম চিন্তা আসে। সে মরে গেলে কী জাহান্নামে যাবে? আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে ভুল বুঝবে না, এই জাতীয় চিন্তাও তার মনের ভেতরে খেলে। কখনো নিজেই নিজের গলা চেপে ধরে। দেখতে চায় শরীরের কতটুকু যন্ত্রণা সে সহ্য করতে পারবে। তারপর এভাবেই আস্তে আস্তে চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া।
এই ধরনের আত্মহত্যা যারা করেন, তারা বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সব পরিকল্পনা করে রাখেন। কোন জায়গায় কখন কাজটি করবেন, সব ঠিক করা থাকে। এমনকী রোগী এসব করাকালীন চরম উত্তেজনা অনুভব করতে থাকেন।
জাপানে “সি অফ ট্রি” নামে একটি বন আছে, যেখানে কিছুদূর হাঁটলেই গাছের ডালে মানুষের কঙ্কাল ঝুলছে। প্রতি বছর এই বনে প্রচুর মানুষ সুইসাইড করতে আসে। অনেক দূর দেশ থেকে অনেক টাকা খরচ করে কেউ কেউ এখানে মরতে আসে। মানুষ নিরিবিলিতে মারা যেতে পছন্দ করে। মৃত্যুর জন্য এই জায়গাটি বেছে নেয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- যাতে কেউ কখনো তাকে খুঁজে না পায়। এ পর্যায়ে এসে অভিমানকে সুইসাইডের একটা কারণ বলতে পারি আমরা।
আত্নহত্যা আরো এক ধরনের হয়, যেখানে রোগী হঠাৎ কোনও আবেগ থেকে আচমকা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। অনেক সময় শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও করে ফেলেন তবে তা খুবই বিরল। এই সব ধরনের লক্ষণগুলিকে এখন ডিসঅর্ডার বলে ধরা হয়। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চরম বিষণ্ণতা বা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন থেকে। অধিকাংশ মানুষ খুব একটা পরিকল্পনা করে আত্মহত্যা করে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সুইসাইড করছে প্রায় দশ হাজার অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ২৭ জন। এই টুকু একটা দেশে প্রতি ঘণ্টায় ১ জনের বেশি সুইসাইড করছে।এজন্যই হয়তো মানুষকে অভিমানী প্রাণী বলা হয়।
মানুষের কথা বাদ দিয়ে এবার পশু-পাখিদের কথা বলা যাক।
প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভারতের একটি বিশেষ জায়গায় এক সাথে অনেক পাখি দলবদ্ধ ভাবে আত্মহত্যা করে। এর কোন নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা এখনো জানা যায়নি। স্কটল্যান্ডের “ওভার টাউন” ব্রিজে প্রতি বছর শত শত কুকুর এসে আত্মহত্যা করে। তারা ব্রীজ থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হলেও এর কোন নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
এবার পশু-পাখিদের কথা বাদ দিয়ে আমরা যদি মানুষের কথাই ভাবি, তাহলে দেখুন- মানুষ কি না করছে? রোবোট বানাচ্ছে, পারমানবিক অস্ত্র বানাচ্ছে, হাতি দিয়ে সার্কাস দেখাচ্ছে, সাপ, সিংহ ,বাঘের মতো হিংস্র প্রাণিদের পোষ মানাচ্ছে। এতো মেধা সম্পন্ন মস্তিস্কে কিভাবে সুইসাইড আসে?!
এতো অভিমান করে আসলে লাভ কি? অভিমান করে চলে যাবার জন্যই কি আমাদের জন্ম হয়েছিলো?!
সব থেকে বড় ব্যাপার কী জানেন ? একজন ধর্ষক , একজন মাতাল , ঘুষখোর , পতিতা এরা প্রত্যেকেই প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ পায়। কিন্তু, আত্মহত্যা আপনাকে প্রায়শ্চিত্ত করার কোন সুযোগ দিবে না।
লেখকঃ মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম রোমান