25 C
Dhaka
Wednesday, December 6, 2023
বাড়িস্বাস্থ্যকথাধীরে ধীরে আত্মহত্যার নাম-ধূমপান

ধীরে ধীরে আত্মহত্যার নাম-ধূমপান

তামাকের উৎপত্তি আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপিয়রা কলোনী বিস্তারের পাশাপাশি এই বিষাক্ত দ্রব্যটি সিগারেট তৈরির আধুনিক মেশিন আবিষ্কার করে বাণিজ্যিকভাবে যারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়। এর জন্য আকর্ষণীয় ব্যায়বহুল বিজ্ঞাপন দেওয়া আর বন্দনা করার জন্য কবি সাহিত্যিকেরও অভাব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েন বলেন যে স্বর্গে যদি সিগারেট খাওয়ার অনুমতি না থাকে তাহলে তিনি স্বর্গে যাবেননা। কয়েক শতাব্দী ধরে সিগারেট আধুনিকতা, অভিজাত্য ও স্পটনেসের প্রতিক হিসেবে থাকার পর একবিংশ শতাব্দীতে এটি চরম ক্ষতিকর প্রমানিত হয়েছে। আমাকে ২০০০-৪০০০ পদার্থ রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ টির বেশি কারসিনোজেন (ক্যান্সার জীবাণু) রয়েছে। তামাকে রয়েছে নিকোটিন যা নেশাসৃষ্টিকারী, হৃদকম্পন ও রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। এতে রয়েছে কার্বনমনস্কাইড যা শরীরে অক্সিজেনের অভাব ঘটায়। ধূমপানে অভ্যস্ত লোকেরা সিগারেট খেলে তাদের মনোযোগ বৃদ্ধি পায়,কিছুটা ক্লান্তি দূর হয় ও মেজাজ ফুরফুরে হয়। এর বিনিময়ে তাদের অসংখ্য শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ফুস্ফুসেরর ক্যান্সার ছিল বিরল। এখন ১৮ লক্ষ লোক প্রতিবছর এই ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে থাকে যার ৯০% কারণ হচ্ছে ধূমপান। ধূমপানের কারণে শ্বাসনালী ,খাদ্যনালী, অগ্নাশয়, কিডনি ও মুত্রথলীতে ক্যান্সার হয়ে থাকে। ৭০% ক্ষেত্রে COPD ব্রঙ্কাইটিসের* কারণ হচ্ছে ধূমপান। ২৫% হৃদরোগের কারণে হচ্ছে ধূমপান। তাছাড়া ব্রেইনের স্ট্রোক, পায়ের রক্তনালি শুকিয়ে যাওয়া, গ্যাস্ট্রিক আলসার, যৌন ক্ষমতা কমে যাওয়া, রোগ প্রতিরোধ কমে যাওয়া ইত্যাদির সাথে ধূমপান জড়িত। Pasive smoking বা পরোক্ষ ধূমপানে মা ও শিশুদের অনেক ক্ষতি হয়। এমনকি মাতৃগর্ভের শিশুর বৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে। ধূমপায়ীদের ওজন অধূমপায়ীদের চেয়ে ২-৪ কেজি কম হয়ে থাকে এবং বৃদ্ধ বয়সে তাদের খাদ্যের রুচি ও স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। ২০২০ সালে সিগারেটজনিত কারণে পৃথিবীতে মৃত্যুবরণ করেছে ৮০ লক্ষ লোক। অথচ এই মৃত্যুগুলো প্রতিরোধযোগ্য।

পৃথিবীতে উন্নত দেশগুলো ধূমপানের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন জনসচেতনতা বৃদ্ধি সিগারেটের উপর বেশি কর আরোপ, সিগারেটের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা, জনসমাগম স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ করা, ধূমপান বন্ধে সহায়তা প্রদান ইত্যাদি। এ ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে তারা সুফল পাওয়া শুরু করেছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ধূমপান ছিল ১৯৬৫ সালে প্রায় ৬৮% যা ২০২০ সালে প্রায় ১২.৫% এ  এসে দাঁড়িয়েছে। তাতে ধূমপানজনিত রোগগুলো অনেক কমে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বোচ্চ তামাক ব্যাবহারকারী দেশের অন্যতম। এখানে প্রায় ৫ কোটি লোক ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক(জর্দা,গুল) ব্যাবহার করে যা জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ %।  বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণা অনুযায়ী ২০১৮ সালে তামাক ব্যাবহারের কারণে ১ লক্ষ ২৬ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটেছে। একই বছর ১৫ লক্ষ লোক তামাক ব্যাবহার জনিত রোগে ভুগছিলেন। প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের সংস্পর্শে আসার কারণে আক্রান্ত হয়। তামাক ব্যাবহারের কারণে স্বাস্থ্যখাতে ব্যায় ছিল ৮ হাজার ৪শ কোটি টাকা যার ৭৬ শতাংশ পরিবার বহন করেছে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে তামাক ব্যাবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৩০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা যা তামাকজনিত আয়ের চেয়ে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। কাজেই এটি আমাদের জন্য মোটেই কোন অর্থকরী ফসল নয়। তামাক উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। **উৎপাদিত তামাকের ১/৩ ভাগ আমরা বিদেশে রপ্তানি করে থাকি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আমাদের এখানে সীমিত আকারে তামাক চাষ শুরু হয়। বর্তমানে তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ২৯৭ একর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। *?

তামাক চাষ একটি কোম্পানি নির্ভর ফসল। বহুজাতিক তামাক কোম্পানি উন্নত বিশ্বে বেশি সুবিধা করতে না পারলেও দরিদ্র দেশগুলোতে বর্তমানে নতুন মার্কেট করে নিচ্ছে। তামাক চাষে কৃষককে প্রণোদনা দেয়া আর সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে দেশে ধূমপানের বিরাট মার্কেট তৈরি হয়েছে। যেমন নেপাল ও মালদ্বীপের মত দেশে সিগারেটের প্যাকেটের উপরের অংশে ৯০% জায়গাজুরে ধূমপানের বিরুদ্ধে বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। আমার আমাদের দেশে সিগারেটের  প্যাকেটের নিচের অংশে ৫০% জায়গাজুরে ঐ বিজ্ঞপ্তি থাকে। আমাদের জাতীয় বাজেট সিগারেট জাতীয় বস্তুতে কর আরপের ব্যাপারেও নমনীয় ভাব পরিলক্ষিত হয়। অথচ এ ব্যাপারে বেশি কর আরোপ হচ্ছে ধূমপান নিবারণের অন্যতম প্রমাণিত একটি উপায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে ১০% দাম বৃদ্ধি করলে ৫% ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দেয়।

তামাক রবি ফসলের সময় উৎপাদন হয়। ঐ সময় নানারকম সবজি ডাল,তৈলবীজ , ধান এসব ফসল না করে জমিতে ক্ষতিকর  একটি ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। তামাক চাষে জমির উর্বরতা দ্রুত হ্রাস পায়। ফলে নতুন জমি চাষের জন্য ব্যাবহার করতে হয়। তামাক চাষে বেশি কীটনাশক ব্যাবহার করতে হয়। তাতে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতি হয়। তামাক পাতা সিদ্ধ করার জন্য প্রচুর জ্বালানীর প্রয়োজন যা পুরন করতে গিয়ে আমাদের বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে ধূমপানজনিত আর্থিক ক্ষতি পৃথিবীতে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। তামাক চাষে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। অনেক তামাক চাষি এই মৌসুমে সন্তানদেরকে স্কুলে না পাঠিয়ে তামাক চাষে ব্যাবহার করছে। এভাবে তামাক চাষ আমাদের স্বাস্থ্য অর্থনীতি পরিবেশ, সীমিত ফসলের জমির জন্য বিরাট হুমকি হিসেবে দেখা যাচ্ছে। কোন কোন মুসলমান আছেন যারা ৫ ওয়াক্ত নামাজ পরেন আবার ধূমপান করেন। একসময় ধূমপানের এত ক্ষতিকর বিষয়গুলো মানুষের জানা ছিলনা। ফলে অনেক আলেম ধূমপানকে মাক্রুহ মনে করতেন। তামাকের এত ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে সৌদি আরব, আল-আজহার সহ পৃথিবীর ৪০০০ এর বেশি ফতোয়া হচ্ছে যে ধূমপান হারাম। এ ব্যাপারে কুরআনের দিক নির্দেশনা হচ্ছেঃ

“ তোমরা নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংসে নিক্ষেপ করোনা”(কুরআন ২ঃ১৯৫)

“আর তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করোনা”(কুরআন ৪ঃ২৯)

প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ইউসুফ আল কারযাভি বলেন যে বিখ্যাত আলেমদের মধ্যে এ ব্যাপারে মতভেদ নেই যে ধূমপান হারাম। চার মাযহাবের ফতোয়া ও এই যে ধূমপান নিষিদ্ধ।

উপরের আলোচনা থেকে আশা করি সুস্পষ্ট হয়েছে যে ধূমপান শারীরিক, আর্থিক ও নৈতিক সব দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষতিকর বস্তু। তা থেকে বাচার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার।

বাংলাদেশ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসিতে প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে এ দেশকে তামাক্মুক্ত করার অঙ্গিকার করেছে। ২০০৫ এবং ২০১৩ সালে ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনগুলোর আওতায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে ধূমপান কমতে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে আরও সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। যেমন তামাক চাষের জমি নিয়ন্ত্রণ আইন, তামাক বিক্রির জন্য লাইসেন্স প্রবর্তন, খুচরা সিগারেট/বিড়ি বিক্রয় বন্ধ করা( তাতে সতর্কবাণীর উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। স্কুল কলেজের পাঠ্য সূচিতে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক অন্তর্ভুক্ত করা। সারা দেশের মসজিদের ইমামদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। বাজার সিনেমা হল, জনসমাগম স্থানে পোস্টারের মাধ্যমে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক প্রচার করা। সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও, সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান অনুরুপ কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারে।

 

-লেখকঃ প্রফেসর কর্নেল ডাঃ জেহাদ খান(অব)

মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
সম্পর্কিত

মন্তব্য বাদ দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বাধিক পঠিত