দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট নামক একটি ম্যাগাজিন ইজরাইলকে পরাশক্তি আখ্যা দিয়ে চলতি বছরেই একটি প্রতিবেদন বের করে। সেই প্রতিবদনে ইজরাইলের প্রযুক্তি খাতের বৈশ্বিক ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য চালিয়ে যাওয়া গবেষণা এবং ২০১৯ সালের পর বৈশ্বিক সাইবার নিরাপত্তা বিনিয়োগে ইসরায়েলের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কি বর্তমানে ইজরাইল একটি পরাশক্তির নাম?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে বৃটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং অন্যান্য বিজয়ী শক্তি মিলে গঠন করে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে আজ অবধি ইসরায়েল একের পর এক দখল করে চলছে ফিলিস্তিনীদের এলাকা এবং সেখানে গড়ে তুলছে ইহুদিদের বসতি। ইসরাইল আয়তনে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশের সমান হলেও পারমাণবিক শক্তির দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে। জন্মের পর থেকেই ইসরাইলি নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বৈরি আরব শক্তি পরিবেষ্টিত অবস্থায় পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়া রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। ১৯৪৮সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টায় জড়িত হয়ে পড়ে। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে বহু ইহুদি বিজ্ঞানী ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে অভিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আর্নেস্ট ডেভিড বার্গম্যান। তিনিই হলেন ইসরাইলের পারমাণবিক বোমার জনক। ষাটের দশকে দেশটি পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়। সে বছর মিসরসহ আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধের শুরুতেই ইসরাইলের নেগেভ মরুভূমিতে পারমাণবিক প্রকল্প গুঁড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে মিসরীয় বাহিনী, কিন্তু প্রেসিডেন্ট কর্নেল জামাল আবদুন নাসের পরিকল্পনাটি বাতিল করে দেন এই ভেবে যে- “ইসরাইল এখনো পারমাণবিক বোমা বানাতে পারে নি সুতরাং নেগেভ মরুভূমিতে দিমোনা প্রকল্প গুঁড়িয়ে দেয়া হবে অর্থহীন।“ কিন্তু তিনি জানতেন না যে, ইতোমধ্যেই ইসরাইল দু’টি পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলেছে এবং বোমা দু’টি নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুতও করে রেখেছে। ১৯৭৩ সালে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বিজয়ী হতে পারে নি। এ যুদ্ধেও ইসরাইলের বিজয়ের মূলে ছিল দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র। যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ইসরাইল ১৩টি পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল। প্রতিটি বোমার ক্ষমতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত আণবিক বোমার সমান।
তবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না থাকলে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র বহু আগে মিসর, সিরিয়া, জর্ডানসহ পার্শবর্তী দেশের দখলে চলে যেত। ১৯৬১ সালে দিমোনা রিঅ্যাক্টর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে ইসরাইলের যুক্তি মেনে নেয়। তবে গোপনে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। সুপরিচিত মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী ইউজেন ওয়াগনার ও আই আই রাভিকে নামমাত্র পরিদর্শনের অনুমতি দিলেও প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ন নিয়মিত আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের অনুমতি দানে অব্যাহতভাবে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের কাছ থেকে এ স্বীকৃতি আদায় করে যে, সে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে তার পারমাণবিক কর্মসূচি ব্যবহার করবে এবং বছরে দু’বার মার্কিন পরিদর্শকদের পরিদর্শনের অনুমতি দেবে। ১৯৬২ সালে এ পরিদর্শন শুরু হয় এবং ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। মার্কিন পরিদর্শকরা ইসরাইলের পারমাণবিক স্থাপনার শুধু বহিঃভাগই পরিদর্শন করেন। কিন্তু স্থাপনার ভূগর্ভস্থ অংশ পরিদর্শনের বাইরে থেকে যায়। ভূগর্ভের উপরিভাগে ভুয়া কন্ট্রোল রুম ছিল। কিন্তু ভূগর্ভে প্রবেশ করার পথগুলো পরিদর্শনকালে গোপন রাখা হতো। সিঁড়িগুলো ইটের আস্তরণ দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। ইসরাইলি পারমাণবিক স্থাপনায় পরিদর্শনের তথ্যও গোপন রাখা হতো। রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা তাতে ৭০ বছর পরও ইসরায়েল আজও একটি শিশু রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া এ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন। এখনও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন- যুক্তরাষ্ট্রের একনিষ্ঠ সমর্থন ছাড়া ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
একটি প্রশ্ন সকলের মনে জাগাটাই স্বাভাবিক যে- আজ পর্যন্ত যতগুলো দেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়েছে তাদের প্রত্যেকেই পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু পারমাণবিক পরীক্ষা ছাড়া ইসরাইল পরমাণু শক্তিধর হলো কিভাবে?? ইজরাইলের লুকোচুরি ইসরাইলকে বাড়তি একটি সুবিধা দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ফ্রান্স ও ইসরাইলের মধ্যে যে ধরনের পারমাণবিক সহযোগিতা ছিল তাতে পারমাণবিক ডিভাইস পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল না। ফ্রান্স ও ইসরাইলের মধ্যকার সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ছিল মূলত প্লুটোনিয়ামের উন্নয়ন। তবে এ বাস্তবতা সত্ত্বেও ইসরাইল বোমা নির্মাণোপযোগী প্রচুর ইউরেনিয়াম মজুদ করেছিল। ইউরেনিয়ামের সাহায্যে তৈরি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। একটি বিশ্বস্ত সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের পরমাণু পরীক্ষার মাধ্যমে একটি নয়, দু’টি পারমাণবিক শক্তির জন্ম হয়েছিল। একটি ছিল ফ্রান্স নিজে এবং আরেকটি ইসরাইল। ফ্রান্সের পরমাণু পরীক্ষাকালে বেশ কয়েকজন ইসরাইলি পর্যবেক্ষক ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
ফ্রান্স একসময় ইসরাইলকে সহায়তা প্রদান বন্ধ করে দেয়। এরপর ইসরাইল নিজের পথ নিজেই দেখে। যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন- এ পাঁচটি দেশের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার অ্যাপোলোতে ছিল ‘নিউক্লিয়ার মেটেরিয়ালস এন্ড ইক্যুয়িপমেন্ট কর্পোরেশন’ (নুমেক) নামে একটি ক্ষুদ্র জ্বালানি রড ফেব্রিকেশন প্ল্যান্ট। ১৯৬৫ সালে মার্কিন সরকার এ কর্পোরেশনের সভাপতি ড. জালম্যান শাপিরোকে অতি সমৃদ্ধ ২০০ পাউন্ড ইউরেনিয়াম খোয়া যাবার জন্য অভিযুক্ত করে। মার্কিন আণবিক শক্তি কমিশন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ও অন্যান্য সরকারি সংস্থা ঘটনাটি তদন্ত করে। কিন্তু তদন্তে কি পাওয়া গেলো তা কেউ প্রকাশ করেনি। অনেকেই বিশ্বাস করেন, ১৯৬৫ সালের কোনো এক সময় ইসরাইল এ ২০০ পাউন্ডের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম লাভ করেছিল। কোনো কোনো সূত্র জানিয়েছে, মোসাদ এজেন্ট রাতি আইতান ও জোনাথন পোলার্ড এ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ইসরাইলে পাচার করেছিলেন।
বেসামরিক সাইবার নিরাপত্তা, সাইবার-গোয়েন্দা সক্ষমতা, সামরিক আক্রমণে সাইবার ক্ষমতার বিকাশ এবং ব্যবহারে ইসরায়েল বিশেষভাবে শক্তিশালী। ইসরায়েল তার সাইবার শক্তিকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে একটি বিশেষ লক্ষ্যে। সেটি হচ্ছে- ইরানকে মোকাবিলা এবং দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া। আজ থেকে ১৫ বছর আগে ইরানের নাটাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রে হাজার হাজার মোটরের গতি বাড়াতে-কমাতে আধুনিক ম্যালওয়্যার ব্যবহার করেছিল ইসরায়েল। ‘স্টাক্সনেট’ নামের সেই ম্যালওয়্যার প্রচুর যান্ত্রিক ত্রুটি তৈরির পাশাপাশি ইরানের ইউরেনিয়াম তৈরিকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। অস্থিতিশীল করে দিয়েছিল ইরান সরকারকেও। ২০২০ সালে সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে একটি ইরানীয় বন্দরের কার্গো ও শিপিং কার্যক্রম নষ্ট করে দিয়েছিল ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শত শত লক্ষ্যবস্তুর উপর বিমান হামলা চালানোর পাশাপাশি এই সাইবার ক্ষমতা গোয়েন্দা খাতে বাড়তি আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দেয় ইসরায়েলকে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাইবার নিরাপত্তা ক্লাস্টারের অবস্থান ইসরায়েলে। সান ফ্রান্সিসকোর পর ইসরায়েলেই সবচেয়ে বেশি সাইবার নিরাপত্তা ফার্ম রয়েছে। সর্ববৃহৎ ৫০০ সাইবার নিরাপত্তা সংস্থার ১২ শতাংশের অবস্থানই মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশে। ইসরায়েল সরকার একটি বেসামরিক সাইবার নিরাপত্তা সংস্থাও স্থাপন করে। যার নাম, ইসরায়েলি ন্যাশনাল সাইবার ডিরেক্টরেট (আইএনসিডি)। অন্যান্য সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির মতো এর কোনো নিরাপত্তা বা গোয়েন্দা মিশন নেই৷ ২০১৩ সালে এডওয়ার্ড স্নোডেন অসংখ্য বৈশ্বিক নজরদারি প্রোগ্রামের তথ্য ফাঁস করে দিলে নজরদারি নিয়ন্ত্রণে স্বাধীন বেসামরিক সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা স্থাপনের দাবি উঠে সব দেশে। সেই দাবি থেকে উত্থান ঘটে আইএনসিডির। নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে আইএনসিডির কাজ শুরু হলেও এখন তথ্য শেয়ারিং ও দৈনিক সাইবার প্রতিরক্ষা কার্যক্রম দেখভাল করাও এই সংস্থার দায়িত্বের মধ্যে এসে পড়েছে।
পরিশেষে আমরা বলতেই পারি যে, পরমাণু খায়েশ এবং প্রযুক্তি সমৃদ্ধির সকল উপায় ও উপকরণ যুগিয়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রবক্তা আমেরিকা, ফ্রান্স, নরওয়ে, বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি প্রভৃতি দেশ। এসব দেশের সহায়তায় ক্ষুদ্র দেশ ইসরাইল পরাক্রমশালী শক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
লেখকঃ মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম রোমান