আজ থেকে কয়েক বছর আগে কে বা জানতো পৃথিবীর বুকে ধেয়ে আসছে মহান রবের পক্ষ থেকে অদৃশ্য এক শক্তি, যা পৃথিবীবাসীকে করবে কোণঠাসা, ছিনিয়ে নিবে লাখো প্রাণ, মানতে হবে বিধি নিষেধ,পড়তে হবে মাস্ক!
করোনা আগমনের পূর্বে আমরা কজন বুঝতাম মাস্ক এর গুরুত্ব,কজনই বা পড়তাম মাস্ক। হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স, ল্যাবরেটরীতে শিক্ষক শিক্ষার্থী এবং কিছু ক্ষেত্রে শ্রমিকরা মাস্ক পরিধান করতো এই যা।কিন্তু পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্ন থেকে মহান সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীকে পরিয়ে দিয়ে রেখেছেন এক অদৃশ্য মাস্ক,যার নাম ওজোন স্তর।
ফরাসি পদার্থবিদ চার্লস ফ্যব্রি এবং হেনরি বুইসন ১৯১৩ সালে ওজোন স্তর আবিষ্কার করেন।পরবর্তীতে ব্রিটিশ আবহাওয়াবিদ জিএমবি ডবসন ওজোন স্তর নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন।মূলত ওজোন স্তর হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের একটি স্তর যেখানে তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় ওজোন গ্যাস থাকে।যেটির অবস্থান বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় স্তর স্ট্রাটোস্ফিয়ার বা শান্ত মন্ডল এর 15 থেকে 30 কিলোমিটার উচ্চতায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে,এই পৃথিবীর মাস্ক স্বরূপ ওজোন স্তর কি দিয়ে গঠিত হয়?এর কাজ কি? আর একে পৃথিবীর মাস্ক স্বরূপ বলার কারণই বা কি! তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক__
বায়ুমন্ডলে তাপ উৎপাদক বিক্রিয়ায় অক্সিজেন পরমাণুর (O) সঙ্গে অবিয়োজিত অক্সিজেন অনুর (O2) রাসায়নিক সংযুক্তির ফলে সৃষ্টি হয় ওজন অনু(O3) এবং তা থেকে গঠিত হয় ওজোন স্তর।
O2+hv——>2O
O+O2——->O3
অর্থাৎ সূর্য থেকে আগত অতিবেগুনি রশ্মির উপস্থিতিতে এক অনু(O2) অক্সিজেন ভেঙ্গে 2 পরমাণু (O) অক্সিজেন গঠন করে, পরবর্তীতে প্রতি পরমাণু অক্সিজেন এক অনু অক্সিজেন এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠন করে এক অনু (O3) ওজোন গ্যাস। এরকম অসংখ্য ওজন অনু মিলে গঠিত হয় ওজোন স্তর।
বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের প্রায় ৯০ শতাংশ স্ট্রাটোস্ফিয়ারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু মজার বিষয় হলো যদি এই ওজনের সবটুকু অংশ সমুদ্রতলের বায়ুচাপ দ্বারা সংকুচিত করা হয় তাহলে এটি শুধুমাত্র ৩ মিলিমিটার (১/৮ ইঞ্চি) পুরু হবে।
এর ঘনত্ব মাপা হয় ডবসন এককে। বিজ্ঞানী ডবসন আবিষ্কৃত স্পেকট্রোফটোমিটারের সাহায্যে এই ঘনত্ব পরিমাপ করা হয়। বিভিন্ন মৌসুম ও অঞ্চলের উপর ভিত্তি করে এই গ্যাসের ঘনত্বের পরিবর্তন হয়। যেমন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের উপর ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব ৩৫০(DU) ডবসন এবং মেরু অঞ্চলের উপর ঘনত্ব 450(DU) ডবসন।
পৃথিবীতে জীবের জন্য সূর্যের উষ্ণতা অপরিহার্য। কিন্তু এই সূর্য রশ্মিতে থাকে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি।সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে থাকা ওজোন স্তর সৌর পরিবারের মানুষের বসবাসযোগ্য এ গ্রহটিকে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে আবহমান কাল ধরে।
ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর মধ্যম মাত্রার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের শতকরা ৯৭-৯৯ অংশই শোষণ করে নেয়। যা ভূপৃষ্ঠে অবস্থানরত উদ্ভাসিত জীবন সমূহের ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম। ওজোন স্তর প্রতিনিয়তই এই অতিবেগুনি রশ্মিগুলো থেকে পৃথিবী কে সুরক্ষা দিচ্ছে। ওজোন স্তরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ভূমিকার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বর কে বিশ্ব ওজন দিবস ঘোষণা করেছে।ওজোন স্তর ও এর সুরক্ষা নিয়ে সচেতনতা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া ওজন দিবসের মূল লক্ষ্য।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, সভ্যতার ক্রম অগ্রযাত্রার সাথে পরিবেশ ও বায়ুমণ্ডলের জন্য ক্ষতিকারক নানাবিধ রাসায়নিকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার ফলে ওজোন স্তর ক্রমাগত ধ্বংস হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী ১৯৭০ সালের পর থেকে স্ট্রাটোস্ফিয়ার এর মোট ওজনের 4% ধ্বংস হয়েছে।১৯৭৯ সালে বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ মেরুর অ্যান্টার্কটিকার ওজোন স্তরে বৃহৎ গর্তের সন্ধান লাভ করেন যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান।উত্তর মেরুর আর্কটিক ওজোন স্তরেও ছোট গর্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরকম নানাবিধ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পুরো পৃথিবী গ্রহ জুড়ে ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ওজোন স্তর বিনাশের কারণ গুলিকে দুটি স্তরে ভাগ করা যায়___
১। প্রাকৃতিক ঘটনাঃ অগ্নুৎপাত,বজ্রপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক ঘটনার ফলে ওজোন স্তর কিছুটা নষ্ট হয়।
২। অতিবেগুনি রশ্মির সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়াঃ ক্লোরো-ফ্লোরো-কার্বন (CFC) নামে একটি রাসায়নিক যৌগ প্রবল বাতাসে স্ট্রাটোস্ফিয়ারে পৌঁছে যায়। আর সেখানে থাকা অতিবেগুনি রশ্মির সাথে বিক্রিয়া করে সিএফসিতে থাকা ক্লোরিন কে আলাদা করে দেয়। এই ক্লোরিন ওজন ধ্বংস করতে জোরালো ভূমিকা পালন করে। এসব কিছু নানাবিধ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়। এছাড়াও কীটনাশক এ ব্যবহৃত রাসায়নিক যেমন মিথাইল ব্রোমাইড,অগ্নিনির্বাপকে ব্যবহৃত হ্যালন ওজন ধ্বংসকারী রাসায়নিক।
ওজোন স্তরের বিনাশের ফলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি অতি সহজেই পৃথিবীর বুকে প্রবেশ করছে। এই অতিবেগুনি রশ্মি গুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক UV – B, যা মানুষের স্বাস্থ্য, উদ্ভিদ, প্রানী, অনুজীব, বস্তু ও বায়ুর গুনমানের উপর ঋনাত্মক প্রভাব ফেলে।
১।মানুষ ও অন্যান্য প্রানীদের উপর প্রভাব – ওজোন স্তরের বিনাশ ও তার ফলে অতিবেগুনি রশ্মির পৃথিবীর মধ্যে প্রবেশ এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রানীদের উপর এই অতিবেগুনির সম্ভাব্য প্রভাব হল চোখের রোগ, ত্বকের ক্যানসার ও সংক্রামিত রোগ গুলির সংক্রমণের প্রভাব বৃদ্ধি অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিমান হ্রাস। অতিবেগুনি রশ্মি – B চোখের কর্নিয়া ও লেন্সের ক্ষতি করে এবং অল্প বয়সে চোখে ছানি পরে যায়। ত্বকের ক্যানসার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি সাদা চামড়ার মানুষদের কারণ এদের শরীরে মেলানিনের পরিমান সবচেয়ে কম থাকে।
২।সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উপর প্রভাব – ফাইটোপ্ল্যাংটন সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এছাড়া বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব নিয়ন্ত্রনেও ফাইটোপ্ল্যাংটন গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। মানুষের প্রয়োজনীয় প্রানীজ প্রোটিনের ৩০% জোগান পাওয়া যায় সমুদ্র থেকে, পরোক্ষ ভাবে যার মূলে রয়েছে সেই ফাইটোপ্ল্যাংটন।এই ফাইটোপ্ল্যাংটন সমূদ্রের সর্বত্র সমান ভাবে পাওয়া যায় না, প্রধানত উচ্চ অক্ষাংশীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পরিমানে পাওয়া যায় এছাড়া মহীসোপান অঞ্চলেও পাওয়া যায়।
গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে আন্টার্কটিকার পার্শ্ববর্তী সমুদ্র অঞ্চলে ফাইটোপ্ল্যাংটনের উৎপাদন অনেক হ্রাস পেয়েছে, যার একমাত্র কারণ আন্টার্কটিকায় ওজোন গহ্বরের সৃষ্টি, যার মাধ্যমে অতিবেগুনি রশ্মি প্রবেশ। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, উভচর ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রানীর প্রারম্ভিক পর্যায়ে ক্ষতি সাধন করে থাকে।
৩।বায়ুর গুনমানের উপর প্রভাব – ওজোন স্তরের বিনাশ ও তার ফলে UV – B এর নিম্ন বায়ুমন্ডলে প্রবেশ। UV – B রশ্মি বায়ুর নিম্ন স্তরে অবস্থিত প্রধান গ্যাস গুলিকে বিশ্লেষিত করে এই গ্যাস গুলির রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার কে নিয়ন্ত্রন করে। যেমন – অতিবেগুনি রশ্মি ওজোন স্তরকে বিশ্লেষণ করে অক্সিজেন অনু ও পরমানুর সৃষ্টি হয় এবং অক্সিজেন অনু বায়ুর হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন পারক্সাইড উৎপন্ন করে, এই হাইড্রোজেন পারক্সাইড মানুষ, উদ্ভিদ ও বিভিন্ন পদার্থের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
৪।পদার্থের উপর প্রভাব – অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ন সিন্থেটিক পলিমার, প্রাকৃতিক বায়োপলিমার গুলি অতিবেগুনি রশ্মির দ্বারা ক্ষতি গ্রস্ত হয়। এই পদার্থ গুলি থেকে তৈরি প্লাস্টিক সূর্যের প্রখর তীব্রতা থেকে রক্ষার পেতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে কিন্তু সৌর বিকিরনে UV – B রশ্মির পরিমান বৃদ্ধি পাওয়ায় এই প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য গুলি ক্রমশ ক্ষয় প্রাপ্ত হচ্ছে। বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তর প্রতিনিয়তই এই মারাত্মক ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি গুলোকে প্রতিহত করে পৃথিবীর প্রাণীকূলকে রক্ষা করছে। সুতরাং বলাই যায়,মানুষের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন যেমন মাস্ক,পৃথিবীর সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন তেমন মাস্ক স্বরূপ ওজন স্তর।
লেখকঃ মোঃ হারুন অর রশিদ