অতন্দ্র অপরাজিতা

0
17

শীতের সকালের নিস্তব্ধতা এখনও পুরোপুরি ভাঙেনি। চারপাশে ঘন কুয়াশা, হুহু করে শীতল বাতাস বইছে।  খুব ধীর পায়ে কলেজের উদ্দেশ্যে হাঁটছে বাসন্তী। একটা লাল জামার উপর কালো চাদর জড়িয়েছে সে। তীব্র ঠাণ্ডায় তার শীত লাগার কথা কিন্তু  সে তেমন করে ঠাণ্ডা অনুভব করছে না। কলেজ গেইটটা পার হতেই বেশ কবি কবি চেহারার একজন সুদর্শন যুবকের সাথে ধাক্কা লেগে গেল বাসন্তির। সে ধাক্কা খেয়েও কিছু না বলে আবার হাঁটতে শুরু করল। যুবকটি মৃদুস্বরে “আই এম এক্সট্রিমলি সরি, ডিয়ার” বলে চলে গেলো।

সাধারণত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া যুবকেরা এত অমায়িক হয় না। বাসন্তী এতই উদাসীন হয়ে হাঁটছে সে এই ভদ্রতাটুকুর আলাদা করে কোনো মূল্যায়ন করতে পারল না। তার চোখে রাজ্যের শূন্যতা। চারপাশে যত না কুয়াশার অন্ধকার তার চেয়ে বেশি অন্ধকার তার মনে। আস্তে আস্তে পা ফেলে ফেলে সে একসময় পৌঁছে গেল ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের প্রথম বর্ষের ক্লাস হয় যে রুমে, সে রুমটায়। একদম ফাঁকা একটা বেঞ্চে জানালার পাশে গিয়ে বসল সে। কিছুক্ষণ পর টিচার এসে ক্লাসে ঢুকতেই সবার মাঝে ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেল। ডিপার্টমেন্টের টিচার সম্পর্কে সাধারণত সবারই একটা ধারণা থাকে। কিন্তু ইনি সম্পূর্ণ নতুন একজন টিচার। তার আচার-ব্যবহার, পড়াবার ধরন সবই আলাদা। প্রথম বর্ষের সকল শিক্ষার্থীরা বুদ হয়ে গেল তার ক্লাসে। প্রথম ক্লাসেই নিষুপ্ত স্যার সবার মন জয় করে নিলেন। ক্লাস শেষে কে কে স্যারের উপর ক্রাশ খেলো, স্যারের চুল, কথা বলার ভঙ্গি, কণ্ঠ সবকিছু নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে লাগল। বাসন্তী জানালার কোণ ঘেষে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরেই তাকিয়ে রইল। সে টিচারকে চিনেছে, সকালে উনার সাথেই তার ধাক্কা লেগেছিল।

ক্লাস শেষে বাসন্তী বাড়ি ফিরে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল। বিকালে যখন ঘুম ভাঙলো তার ঘর নিগূঢ় আঁধারে নিমজ্জিত। সে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তাকে তার রুমের বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে মা গিয়েছেন কোনো কাজে। সে অন্ধকারে জড়সড় হয়ে বসে ভয়ে চুরমার হয়ে যেতে লাগল। প্যানিক এটাক বলতে যা বোঝায় তা-ই হলো তার।

গত এক মাস সে বাড়ির বাইরে যায় না। বাসার ভাড়াটিয়া থেকে শুরু করে সবার মুখে একই প্রশ্ন, “কই চান্স পাইছো?” এর জবাব নেই বাসন্তীর কাছে। সে ভর্তিযুদ্ধে হেরে গেছে। তার পক্ষে যতটুকু পরিশ্রম করা সম্ভব সে করেছিল। কিন্তু শেষমেশ টাইফয়েড এসে তার সব প্রস্তুতি এলোমেলো করে দিল। এই কথাগুলো মনে হতেই সে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে অন্ধকার ঘরেই এক সাগর হতাশায় ডুবে আবারও সে তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।

দুইদিন পর আবার কলেজে গেল বাসন্তী। ক্লাস শুরু হওয়ার অনেকটা আগেই চলে এসেছে সে। সময় কাটানোর জন্য কলেজ লাইব্রেরিতে ঢুঁ দিল। সেখানে হুমায়ুন আহমেদের কিছু বই নাড়াচাড়া করে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের “ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি” বইটা নিয়ে বসে পড়ল। সেদিন ক্লাসে নতুন টিচার এই বইয়ের কিছু অংশ নিয়ে কথা বলেছিলেন। সান্তিয়াগো নামক এক বৃদ্ধলোক; যিনি টানা চুরাশি দিন চেষ্টার পরেও একটা মাছও ধরতে পারেননি, তাকে নিয়ে লেখা বইটি। কীভাবে তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে, সব থেকে বড় মাছটি ধরবেন বলে গভীর সমুদ্রে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন সে গল্প বলা হয়েছে উপন্যাসটিতে।

বইয়ের কিছু লাইনে বাসন্তীর দৃষ্টি আটকে গেল। “A man can be destroyed but not defeated!” সত্যি-ই কি তাই?

ক্লাসের সময় প্রায় হয়ে গেছে। বইটা বন্ধ করে সে ক্লাসের দিকে রওনা হলো। আজকেও নিষুপ্ত স্যারের ক্লাস আছে। এটা ভাবতেই বাসন্তীর মন কিছুটা হালকা হয়ে গেল। এর কারণ কী! বাসন্তীর অজান্তেই স্যার হয়তো তার কাছে প্রিয় হয়ে উঠছেন! ক্লাসে রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত কবিতা “Stopping by Woods on a Snowy Evening” আবৃত্তি করে করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন স্যার। বেশ ভালো লাগছে স্যারের কথাগুলো শুনতে। মনে মনে “And miles I go to before I sleep” উচ্চারণ করতেই বাসন্তীর চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সে ঘন ঘন পলক ফেলে অশ্রু সামলে নিল। ক্লাস শেষে সবাই উঠে যাওয়ার পরেও জানালার বাইরে আনমনে তাকিয়ে রইল সে।

হঠাৎ বেঞ্চে খটখট আওয়াজ শুনে চমকে উঠল। তার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য নিষুপ্ত স্যার বেঞ্চে শব্দ করছেন। সে কিছুটা লজ্জিত হয়ে নড়েচড়ে বসল। খুবই কোমল কণ্ঠে টিচার তার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। বিচক্ষণ স্যার আগেই বুঝে গিয়েছিলেন বাসন্তীর প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ। তিনি হুমায়ুন আহমেদেরই একটি মূল্যবান বাণী দিয়ে কথা শুরু করলেন।

“আপনার প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের একটা কথা আছে, ‘পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই যা করলে জীবন ব্যর্থ হয়। জীবন এতই বড় ব্যাপার যে একে ব্যর্থ করা খুবই কঠিন।’ সামান্য একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিছুতেই আপনার মূল্যবান জীবনের দাম নির্ধারণ করতে পারে না। ক্লাসে বসে বাইরে বেখেয়ালিভাবে তাকিয়ে না থেকে, একটু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করুন।  এই যে বাউন্ডারির দেয়ালের অবহেলিত শ্যাওলাগুলোকে দেখুন, নিজ শক্তিতে পুরো দেয়ালটা সবুজ করার যুদ্ধে তারা কীভাবে মগ্ন। ওদিকে বাগানের গাছগুলোকে দেখুন, একদিন পরিচর্যা না করলেই কেমন নেতিয়ে যায়। এই রংচটা দেয়াল থেকে নিঃসন্দেহে বাগান ভালো স্থান। কিন্তু কে বেশি শক্তিশালী? শ্যাওলা নাকি ওই ঝিমিয়ে পড়া ডালিয়া? ভেঙে পড়লে হবে না। নিজের জায়গা থেকে এগিয়ে যেতে হবে। বুঝতে পারলেন? নতুন লক্ষ্য স্থির করেন আর সেই অনুযায়ী কাজ করেন। জীবনে অনেক বড় হতে হবে, নিজের মূল্য নিজেকেই বাড়াতে হবে। বাবা-মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে হবে।”

বাসন্তী কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি মেলে স্যারের দিকে তাকাল। তার ব্যাগে কিছু ক্যান্ডি ছিল সেখান থেকে কয়েকটা ক্যান্ডি স্যারের দিকে এগিয়ে দিয়ে “থ্যাংক ইউ, আই এম সরি, এন্ড অলসো গ্রেটফুল টু ইউ, স্যার” বলে উঠে পড়ল বেঞ্চ থেকে।

সেদিন ক্লাস থেকে ফিরে বিশ্রাম শেষে বাসন্তী ডায়েরি নিয়ে বসল। যতটা সম্ভব গুছিয়ে আজকে স্যারের বলা কথাগুলো লিখল। তারপর অনেক ভেবে-চিন্তে ” নিউ ইয়ার রেজ্যুলিউশন” শিরোনামে নতুন বছরের প্রতিটি দিন কী কী করবে তা  নোট করল। নিয়মিত ব্যায়াম, নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো-খাওয়া, প্রার্থনা, বই পড়া, মুভি দেখা, বাগান করার পাশাপাশি সে একটা নতুন দক্ষতা অর্জন করারও সংকল্পের পরিকল্পনা লিখে রাখল ।

তারপর পরিপাটি হয়ে মায়ের সাথে ছাদে উঠল। শীতের রিক্ততা সবগুলো তরতাজা গাছকে কাবু করে ফেলেছে। নিয়মিত সকাল-বিকাল পানি দেওয়ার পরও গাছগুলো যেন কাঙ্ক্ষিত প্রাণশক্তি পাচ্ছে না। বাসন্তী গাছ থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। কী সুন্দর আকাশ! রংটা বর্ণিল না কিন্তু মোলায়েম। বহুদিন পর সে শালিক, চড়ুইয়ের ডাক শুনল যেন।

হঠাৎ সে খেয়াল করল এতসব যত্নে বেড়ে উঠা গাছগুলোকে ছাড়িয়ে টবের গোড়ায় অযত্নে জন্মানো একটি নীল অপরাজিতা গাছ তরতর করে বেড়ে উঠছে আপন গতিতে। নীল নীল ফুলে আলো হয়ে আছে গাছটি ঠিক যেন সেই কলেজের বাউন্ডারির দেয়ালের সবুজ শ্যাওলাগুলোর মতো। একটা সামান্য অপরাজিতা ফুল যদি স্বমহিমায় এভাবে অযত্নে অবহেলায় বর্ণচ্ছটা ছড়াতে পারে, বাসন্তী কেন পারবে না নিজেকে আবার আগের মতো উদ্যোমী আর আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে! সে ও কি হতে পারে না একটি অপরাজিতা গাছের মতো মজবুত? যে অন্যের মুখ থেকে উচ্চারিত সমস্ত পরাজয়ের তাচ্ছিল্যকে তুচ্ছ করে উঠে দাঁড়াতে পারে সবাইকে ছাড়িয়ে? নিশ্চয়ই পারে। সে আবারও ঘুরে দাঁড়াবে সব ব্যর্থতাকে ভুলে গিয়ে। জীবনে তাকে অনেক বড় হতে হবে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। বাসন্তী নীল অপরাজিতাগুলোর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে  প্রশান্তিভরা চিত্তে হুবুহু নিষুপ্ত স্যারের মতো করে আবৃত্তি করতে লাগল,

“The woods are lovely, dark and deep,

But I have promises to keep,

And miles to go before I sleep,

And miles to go before I sleep.”

লেখকমুনিয়া রশীদ চৌধুরী।

শিক্ষার্থী, বৃন্দাবন সরকারি কলেজ

মন্তব্য বাদ দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন