একমাত্র আশ্রয়স্থল নিজস্ব বাসভবন। সেখানে চলাফেরা স্বাধীনতার পাশাপাশি নিরাপত্তাও থাকে। যখন খুশি যেথায় ইচ্ছে অবাধে বিচরণ করা যায়। অন্য কারো হস্তক্ষেপ নেই। যে যার মত নিজ বাসভবনে অবস্থান করবে এটাইতো ব্যক্তির স্বার্থকতা। শান্ত শীতল মনোরম পরিবেশে ভরপুর নিশাতনগর। এখানে মানুষ মিলেমিশে থাকে। ধনী গরীব বৈষম্যহীন। বিপদে মুসিবতে এগিয়ে আসে একজন অপরজনের কাছে। বুঝার অবকাশ নেই যে এটিও নগর। প্রয়োজনাতীত ছাড়া এই নগরে বহুতল ভবন খুব কমই চোখে পড়ে।
পরিকল্পিত নগরায়ন বললে ভুল হবে না। কোন অসহায় পেটের ক্ষুধা নিয়ে পথে গমন করে না। শরীর না ঠেকলে গাছের ছায়ায় সবুজ প্রকৃতির মাঝে জিরোয়। সারি সারি গাছ, পাখিদের গুঞ্জরণ, পুকুরে হাসের খেলা, কানা বগীর আসা যাওয়া এ সবই যেন জানান দেয় গ্রাম্য পরিবেশের উপস্থিতি। নিপুণ ও নানন্দনিক। নির্দিষ্ট স্থানে স্থানে অতিরিক্ত বক্স রাখা তা যেন শুধু গরীব বা নিম্নশ্রেণীদের জন্য; মোটেও না ধনীরাও সারি সারি বসে একসাথে মিলেমিশে মানবতার বক্স থেকে খাবার সংগ্রহ করে অনায়াসে ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে। নেই কারো সাথে কারো হিংসা বিদ্বেষ ও হেয় প্রতিপন্নতা। বিরাজমান আছে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসাও সহমর্মিতা। নানা ধরণের মানুষ আর সবার সাথে সবার সমন্বয় সম্প্রীতি। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় প্রতিবারই বিশ্বচাম্পিয়ন। উৎকৃষ্ট সম্ভবনাময় সৌন্দর্যের প্রতীক। কিন্তু মনের দিক দিয়ে এ শহরের মানুষ অতি দূর্বল। এক ফ্লাটে বাসা হওয়া সত্ত্বেও তাদের মাঝে দেখা হওয়া বিরল ভাগ্যে। ব্যস্ত সকলে নিজ নিজ কাজেকর্মে। একা থাকার মনভাবে ছোটরা যেমন বেড়ে উঠছে ঠিক তেমনই বড়রা আরও এক বিষন্নতার অনুভবে সময় হারাচ্ছে। পাশে বসে গল্প করার মানুষের বড্ড অভাব।
ফরহাদ সাহেব এসব সাতপাঁচ ভাবনায় নিমগ্ন। তার ছেলেটা শহরে থাকে শহুরে ব্যাচেলর থাকার অনুভূতি সে জানে বুঝে কতটুকু মন মরা হয়ে থাকা জীবন। ছেলেটা বাসায় এলেই স্কুল মাঠে ছুটে সবার সাথে দেখা করে। যেন কত কাল দেখা হয় না। প্রকৃতির সাথে মিশে নতুন এক প্রশান্তির উন্মেষ তৈরি করে মননে। নিশাত-নগরে তিনি লেখাপড়া জানা মানুষ। মানুষকে সততার শিক্ষা দেন। শিক্ষকতাও করেন ছোট্ট একটি স্কুলে। শিক্ষক হিসেবে বেশ পরিচিত। ভাল নাম ডাক। সাদামাটা মানুষ পাড়া–প্রতিবেশির সাথে সখ্যতায়ও অনন্য। হৃদয়ে লালন করা স্বপ্নের কথা সকলের মাঝে শেয়ার করেন। উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হন।
ধীরে ধীরে মানুষজনের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠেন। তার সুশোভিত প্রাঞ্জল্য স্বপ্ন এই দেশটাকে নিয়ে, দেশের মানুষদের নিয়ে। সুপ্ত চিন্তা চেতনায় উজ্জীবন হয়ে নতুন করে এক সাথে হাতে হাত রেখে প্রভুদের দখলদারিত্ব মুক্ত করা। এইসব পেরেসানে দিন পার করে। রফিক আলীর সাথে সাক্ষাৎ হয় তিনিও একই ধাঁচের মানুষ দুজনের বেশ জমে দেশের কথা জনমানুষের কথা আলোচনায়। একদিন আলোচনা শেষে বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে বাসায় চলে আসে। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে । নেই কোন যন্ত্রাংসের কৃত্রিম আওয়াজ, নিরালয়, কোলাহল মুক্ত। চারিদিক নিঝুম নিস্তব্ধ রজনী।
সকলে ঘুমে আচ্ছন্ন এমন সময় কার যেন দরজায় কড়াঘাত। দরজা খুলেই চমকে উঠেন ফরহাদ সাহেব। দেরি হওয়ায় ঘরের ভিতরে এসে কিছু বুঝে উঠার আগে যে যেমন পারে বুট ও ডান্ডার বাড়ি বসিয়ে যায় চাদরাবৃত শরীরের উপর। ফরহাদ সাহেবের চিৎকারে সাদিয়া, মিম ও সালমা জেগে যায়। আঙিনায় বের হতেই চোখে পড়ে অস্ত্রসজ্জিত কিছু দানব। থমকে দাঁড়ায় হাজারো কাকুতি মিনতি করেও নিস্তার মেলে না।
ফরহাদ সাহেবকে অন্য ঘরে আটকে ফেলে স্ত্রী সাদিয়া ও দুই বোনের উপর জানুয়ারের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা; অমানবিক নির্যাতনের স্বীকার হন। ফরহাদ সাহেবের চোখ যেন রাতের আঁধারে ঠিক দিনের আলো। কোন দেওয়াল তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ও ঘেরাও করতে পারে না। অন্য ঘরে থেকেও তার দৃষ্টি ফোকাস থেকে অধিকতর ফোকাস হচ্ছে। সব কিছুই নির্মল ও স্পষ্ট দেখতে পায়। চিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে। মুহুর্তে
বৃক্ষরাজি ও পাখপাখালির মায়ামাখা প্রতিবাদী আওয়াজ ভেসে এসে কর্ণকুহর স্পর্শ করে। হৃদয়কে শান্তনা দেয়। হাত পা বাধা নিরুপায় সে।
জানালা দিয়ে গ্রীল গলে আলো প্রবেশ করে আঁধার তবুও হৃদয়ের আলো দিয়ে আকাশ পানে চেয়ে থাকে । কতটা অমানবিক হলে গ্রুপিং করে নরপশু আস্ত পিশাচের মত এই বাড়িতে প্রবেশ করেছে।। ফরহাদ সাহেবকে পুনরায় ঘর থেকে বের করে আবারো মারধর করে। এতটাই বেশি যে নাক মুখ দিয়ে তাজা রক্ত গলগল করে বের হয়, নিরবে চোখের কোণ দিয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ছে। একবার দুচোখ খুলে আবার বন্ধ করে। সচেক্ষে সহধর্মিণী ও বোনের বস্ত্রহরণ তা দেখা খুবই কষ্টদায়ক। যেন মানুষ না একেকটা ক্ষুধার্ত বাঘ। ফরহাদ সাহেব মনে মনে ভাবছে কিছু কিছু পশু আছে হিংস্র হয় না, কিন্তু এরা মানুষ নামের পশু কতটা হিংসাত্বক ও বিকৃত কামনার । তা নিজ চোখে না দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হত। শক্তি সাহস থেকেও নিশ্চুপ! এটিই তার জীবনের সবচেয়ে বড় লজ্জাজনক অধ্যায়! একটি পরিবার একজন পুরুষ কি করবে দিশাহারা হয়ে বেহুস হয় হুস ফিরে আর বিবেককে জাগরিত করে হৃদয়ের ঘূর্ণী দিয়ে নিজেও প্রতিবাদ করে। আর আলতো করে বলে এটাই কি বেঁচে থাকার স্বাধীনতা! এটাই কি মিথ্যার সাথে আপোষ না করা সত্য পথে চলে সত্য কথা বলার পুরস্কার। এটাই কি সুশীলদের মনুষ্যত্ব? স্ত্রী সন্ত্বানাদীর সম্মুখে উভয়ের হেনস্থা এই স্মৃতি নিয়ে বাঁচবে কীভাবে। বেঁচে থাকার ইচ্ছা কমে আসছে। কী দোষ, কোন অপরাধ বলা শেষ না হতেই গুলির তীব্র আওয়াজে ফরহাদ সাহেব লুটিয়ে পড়েন।
-আজম সিদ্দিক রুমি