25 C
Dhaka
Wednesday, December 6, 2023
বাড়িগল্পবাবা একদিন আসবে

বাবা একদিন আসবে

সপ্তাহে দুদিন বিকালবেলা মাঠে যাওয়া বাধ্যতামূলক। অসুস্থ হলে ছুটি নিতে হয়। অবশ্য এটা খুব ভাল দিক। কতক্ষণ আর চারপাশের দেয়ালে আবদ্ধ থাকা যায়, দীর্ঘসময় ঘরবন্দি থাকা কষ্টকর। এ কষ্ট লাঘবের জন্য হয়তো এত সুন্দর ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। খেলাধুলা করলে দেহমন সুন্দর থাকে। মাথায় অতিরিক্ত চাপ কম পড়ে । পড়াশোনায় মনযোগ আসে। মাঠে বিভিন্ন ধরনের লোকের সমাগম হয়। ব্যস্ত খেলার মাঠ। কিছুটা গ্রাম বাংলার প্রতিচ্ছবি। মাঠের পাশ জুড়ে নানান রকম দোকান পাট। বাহারি আয়োজন। মাঠের প্রান্তে কেহ দাড়িয়ে খেলা দেখে কেউ বা বসে। যাদের ডায়বেটিস প্রবলেম তাদেরও দেখা মেলে। মাঠের কোণ দিয়ে সরু পথ আছে পথচারী চলে, সেখান দিয়ে মাঠের এরিয়ার মাঝে রাউন্ড দেয় তারা। কেউ বসে গল্পও করে। সত্যি অনন্যে পরিবেশ।
বর্তমান সময়ে ছেলেমেয়েরা সহজলভ্য ইন্টারনেটের কারণে ঘরে থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সুযোগ পেলেও মাঠে আসতে চায় না। দিন দিন মাঠের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। দুস্কৃতিকারীও লোভী ব্যক্তিদের জন্য খেলার মাঠে গড়ে উঠছে বড় বড় দালানকোঠা, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। খেলাধুলা থেকে দূরে থাকতে থাকতে নানা ব্যাধিতে জর্জরিত হচ্ছে সমাজ। ভিডিয়ো গেম ও ইউটিউবে ডুবে থাকে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে মাঠ যেন রূপকথা। প্রশ্ন করা হলে মাঠ সম্পর্কে বলতে পারবেই বা কজন! মাঠ কিসের জন্য! মাঠের রঙ কেমন? হয়তো অনেকে মাঠও চেনে না! আর এ দিকে ভিন্নধর্মী একটা স্কুল। মননশীলতা বৃদ্ধির জন্য অভিনব ব্যবস্থা। ছাত্রদের মাঠে নেওয়া হয়। খেলায় ভাল পারফরম্যান্স করলে পুরস্কারের ব্যবস্থাও আছে। পুরস্কার হিসেবে বিভিন্ন জ্ঞানমূলক বই, ছোটোগল্পও কবিতার বইও থাকে। এই বিষয়টা আকর্ষণীও। ছাত্ররা খুব উপভোগ করে। খেলাধুলা শেষে পুনরায় হোস্টেলে পৌঁছে দেয়। ঢাকা শহর। উত্তরার মত জায়গায় সেক্টরে বড় মাঠ পাওয়া দুষ্কর। স্কুল থেকে মাঠ দূরে হওয়ায় স্কুলবাস ব্যবহার করে। মাঠে মিলেমিশে খেলাধুলা আর চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশে অসাধারণ একটি বেলা কেটে যায় সবার। আজকে সাইফও এসেছে ভালই লাগে তার। কিন্তু আজ না খেলে চুপচাপ বসে রয়েছে। সবার জিনিসপত্র যোগাচ্ছে। সহপাঠীরা খেলছে আর সে দেখছে। এক সময় লক্ষ্য করে মাঠের এক কোনায় তার থেকে একটু দূরে একজন বাবা তার ছেলেকে নিয়ে বল খেলছে। দুজনই ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে। বাবা একবার ব্যাটিংয়ে নামে তো ছেলে বল করে, ছেলে ব্যাটিংয়ে  নামে তো বাবা বল করে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বাবার ব্যাটিং করা দেখছে । চোখ ফেরানো যায় না। ব্যাট টার্চ করে একবার বল সাইফের কাছেই চলে এল। বলটি নিয়ে খুব সুন্দর ভাবে ছেলেটিকে এগিয়ে দিল। তারও যেন খেলতে ইচ্ছে করছে তাদের সাথে। কিন্তু এ মূহুর্তে বলতে পারল না। নীরবে বলার সে অনুভূতি দমে যায়। বুকের ভিতর চাপা কষ্টে বাবার অনুপস্থিতি খুব করে মনটায় নাড়া দিল। আর তাদের খেলার একমাত্র সেরা দর্শকের সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেল। মাঠে কতজনই তো খেলছে কারো দিকে চোখ যায় না। আজকে এসেছে যেন তাদের খেলা দেখতেই। বাবা ছেলের খেলার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে। এ স্মৃতি যে অম্লীন। ভুলে যাবার নয়! এর চেয়ে ভাল দৃশ্য হতেই পারে না।
সবাই সবার মত খেলা শেষে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। বাবা ঘাড়ে ছেলেকে নিয়ে তারাও এক সময় চলে গেল। যতক্ষণ আড়াল না হল ততক্ষণ সাইফ চেয়ে রইল। আহা! কতই না মধুর সম্পর্ক। কী অমায়িক এ বন্ধন ! এ বন্ধন যে চিরায়ত কল্যাণও প্রশান্তির। বটবৃক্ষের ছায়াহীন শরীরে শরতের রোদ ও চৈত্রের খরতাপ- দুটোর পার্থক্য সমান। কোথাও অমিল নেই? না তাপমাত্রা না তার প্রশান্তিদায়ক বাতাস। সব কিছুই এক। গরম হলে গরম আর ঠান্ডা বইলে ঠান্ডা! চারদিকে কিচিরমিচির আওয়াজ ! পাখিরাও নীড়ে ফিরছে, মাঠে লোকসমাগম কমতে শুরু করেছে। ডিমের মত লাল কুসুমে পশ্চিমাকাশ ভরে যাচ্ছে। সূর্য অস্তমিত হচ্ছে। সন্ধ্যা নেমেছে। ঝিরিঝিরি শিশির জমতে শুরু হবে সবুজ দূর্বা ঘাসে আর কিছুক্ষণ পরই। স্কুলবাসে চড়ে সাইফও হোস্টেলে ফেরত আসে। কিছুক্ষণ পর রাতের কোচিং শুরু হবে। আজকে যে তার মনটা মাঠেই পড়ে আছে। বাবা ছেলের খেলার কথা স্মৃতিপটে ভাসলেই মনটা ভীষণ রকম খারাপ হয়ে যায়। ইশ! তার বাবাও যদি একদিন এসে একসাথে খেলা করতো। কতই না ভাল লাগতো! তারও ইচ্ছে বাবাকে ব্যাটে দেখা; বল করা। সাইফ পড়াশোনায় ভাল। শান্তশিষ্ট স্বভাবের ছেলে। কখনো ক্লাস ফাঁকি দেয় না। অলসতা করে না। তারসাথে অনেক সহপাঠী বন্ধুরা আছে। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে প্রায় ছুটি চায়। ক্লাসে যায় না। এর বই ধরে ওর বই ধরে। কারো লুঙ্গি ধরে টান দেওয়া কিংবা কারো প্যান্ট লুকিয়ে রাখা, যেন তাদের ভালই লাগে। দুষ্টুমি করার জন্য সুপার স্যারের কাছে কত বকুনি খায় এমনকি মারও খায় তবু শিক্ষা হয় না। একবারতো দুষ্টুমির জন্য পিয়াসকে টি.সি দিয়েই দিল। সে কী কান্নাকাটি। যেন ফেরেশতা! কিচ্ছুটি বুঝে না। বাসায় নালিশ দিয়েছে! তাই ভয় করছে, যদি এসে বকে। কিন্তু সেরকমটা না, বিপরীত কিছু হল। তার বাবা সুপার স্যারের ফোন পেয়ে সকাল দশটায় স্কুলে এল। কত্ত রকম ফলমূল নিয়ে। কোনকিছুর যেন কমতি নেই।
স্যারের সাথে এক রুমে অনেকক্ষণ কথাবার্তা শেষে বের হন নিলয় আহমেদ। হোস্টেলে এসে পিয়াসকে খুব আদর যত্ন করে বুঝিয়ে পুনরায় রেখে যায়। সবার বাবা এলে সাইফের আত্মা যেন শীতল হতে থাকে। সাইফের মাথায় হাত বুলিয়ে নিলয় আহমেদ বিদায় নেন। সাইফের মনটা একটু ফুরফুরে হল। সে যেন অন্যরকম এক পুরোনো হাতের স্পর্শ পেল। এ স্পর্শের হাতদুখান যে তার চেনাচেনা লাগে। তার বাবার মতই ছিল! কী আশ্চর্য এতটা অনুভূতির মিল হয় কেমন করে? সহানুভূতিশীল মায়ার হাতগুলোর কি সব এক রকম স্পর্শ থাকে ? সবার হাতের কোমল ছোঁয়া কি একই? সে ভাবতে লগল অনবরত আর মনে মনে আওড়াচ্ছে একদিন তার বাবাও এসে তাকে এই কোমল দু’হাতের উম দেবে।
লেখকঃ আজম সিদ্দিক রুমি 
শিক্ষার্থী – আইইউবিএটি
ডিপার্টমেন্ট অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
সম্পর্কিত

মন্তব্য বাদ দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বাধিক পঠিত