নতুন আঙ্গিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন

0
15

চার দফা দাবিতে চতুর্থ কোটা-সংস্কার আন্দোলন চলছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। দাবিগুলো হলো- ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধা ভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখা; পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন পূর্বক দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরির সমস্ত গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেওয়া (সুবিধা বঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী ব্যতীত); সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্যপদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধা ভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

দেশের কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ জুন থেকে এ পর্যন্ত আন্দোলন চলছে। এতে করে ঢাকা-সহ সারা দেশের বিভিন্ন সড়ক মহাসড়কে ঘণ্টাব্যাপী তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তাদের সকল দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়-সহ সরকারিকলেজের শিক্ষার্থীরাও

শুরুতে ৪ জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশেপাশের কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা মিছিল শুরু করে। পরে তারা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়, যা চলে এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত।

এদিন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী শাহবাগ মোড়ে জড়ো হওয়ায় রাস্তাঘাটে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছিল। “কিন্তু আমরা এম্বুলেন্সের যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছি” বলে জানান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এদিন শাবিপ্রবিতেও সকাল ১১টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এদিন আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। তাদের এই আন্দোলনের কারণে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত তীব্র যানজট হয়েছে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা মিলে এদিন দুপুর ১২টা সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কে অবস্থান নেয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও কয়েক হাজার শিক্ষার্থী কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। তারা সকাল ১০টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলমান রাখে।

এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীয়া এক ঘণ্টা ধরে বন্ধ রাখেন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কও। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে বন্ধ থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও।

২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল বাংলাদেশে। তার মাঝে ৩০ শতাংশই ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের এই রায় স্থগিত না করায় পূর্বের নিয়মানুযায়ী সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আপাতত বহাল রয়েছে।

ওই বছরই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল যে কোটা ৫৬ শতাংশ না হয়ে ১০ শতাংশ করা হোক।

তাদের দাবির মুখে সে বছর সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করার, এর একটি পরিপত্র তখন জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

কিন্তু ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে পাবার জন্য উচ্চ আদালতে রিট করেন এবং গত পাঁচই জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। তারপর হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। বৃহস্পতিবার সকালে কোটার পক্ষের এক আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানি করেনি আদালত।

সুতরাং, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের এই রায় স্থগিত না করায় পূর্বের নিয়মানুযায়ী সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আপাতত বহাল রয়েছে।

হাইকোর্টের ওই রায়ের পর গত ছয় জুন থেকেই তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে কিছুদিন আন্দোলন চললেও মুসলিমদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-আজহা চলে আসায় ২৯শে জুন পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখেন শিক্ষার্থীরা।

এরপর গত ৩০শে জুন থেকে ফের আন্দোলন শুরু করেন তারা এবং পহেলা জুলাই থেকে এই আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

“একটা চাকরিতে ১০০ আসন থাকলে ৫৬টি যদি রিজার্ভ থেকে যায়, তাহলে বাকী ৪৪টা সিটে আমরা ১০ হাজার মানুষ লড়াই করব। আর ঐ ৫৬টি সিটের জন্য তারা মাত্র দুই তিন হাজার জন লড়াই করবে। সাধারণ জনগণ তো এভাবে বৈষম্যের শিকার হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ কোটা, এটা মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের পর্যন্ত মানা যায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের পর্যন্ত মানা যায় না। আগে যখন আমরা পাকিস্তানের অধীনে ছিলাম, তখন পাকিস্তানিরা আমাদের চেয়ে বেশি কোটা নিতো। কিন্তু এখন স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা বেশি কোটা নেয়। এভাবে চললে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।” বলে মনে করেন আন্দোলনকারীরা। তারা আরও প্রশ্ন করেন, ‘দুই শতাংশ লোকের জন্য ৫৬ শতাংশ কোটা কীভাবে যৌক্তিক হয়?”

শিক্ষার্থীরা সমতার পক্ষে উল্লেখ করে আন্দোলনকারীরা বলেন, “কোটা পুনর্বহাল করার মাধ্যমে তো সুযোগের সমতা থাকল না। সংবিধানের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদ খেলাপ করা হচ্ছে। মাত্র কয়েক শতাংশ মানুষের জন্য “৩০ শতাংশ কোটা কীভাবে সম্ভব?”, এই প্রশ্ন রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা-পদ্ধতি সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরাও।

কোটা পদ্ধতির সংস্কারের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবি জানিয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এই দাবিগুলো তুলে ধরছে।

এর মধ্যে রয়েছে- ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি সংস্কার করা এবং কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা কোটায় শূন্যপদ পূরণ করা, একজন ব্যক্তি যেন তার জীবদ্দশায় সব ধরনের সরকারি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একবার কোটা ব্যবহার করতে পারে, প্রতিটি জনশুমারির সাথে অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে বিদ্যমান কোটার পুনর্মূল্যায়ন নিশ্চিত করা, দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

এসময় শিক্ষার্থীরা ‘সংবিধানের/মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ,’ ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার”, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’, “কোটা প্রথা, বাতিল চাই বাতিল চাই’, ‘কোটা প্রথার বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট একশন’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাই নাই’ এমন স্লোগান দিতে থাকেন।

মিরর ডেস্ক

একটি উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে