এস. এম. এম. মুসাব্বির উদ্দিন
এইচআইভি (হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) এমন একটি ভাইরাস যা মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে ফেলে। এটি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে দেহ সহজেই বিভিন্ন সংক্রমণ এবং রোগে আক্রান্ত হয়। এইচআইভি শরীরে প্রবেশের পর ধীরে ধীরে ইমিউন সিস্টেমের সেল বা কোষগুলোকে ধ্বংস করতে শুরু করে, বিশেষ করে সিডি৪ (CD4) কোষগুলোকে, যা শরীরকে সংক্রমণের বিরুদ্ধে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
এইচআইভির ইতিহাস
এইচআইভির প্রথম সনাক্ত হয় ১৯৮০ সালের দিকে। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই ভাইরাসটি ১৯২০-এর দশক থেকেই আফ্রিকার কঙ্গো অঞ্চলে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তখন ভাইরাসটি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর, এটি বিভিন্ন মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৮১ সালে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এইচআইভি-সংক্রান্ত রোগ অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি সিন্ড্রোম (এইডস) চিহ্নিত করা হয়। তখন থেকে এইচআইভি এবং এইডসের গবেষণা শুরু হয় এবং ভাইরাসটি সম্পর্কে ধীরে ধীরে অনেক তথ্য প্রকাশিত হয়।
সংক্রমণ পদ্ধতি
এইচআইভি প্রধানত রক্ত, বীর্য, যোনিপথের তরল, এবং বুকের দুধের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির শরীর থেকে অন্য ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এই ভাইরাসটি সাধারণত নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে ছড়ায়:
১) অসুরক্ষিত যৌনমিলন: এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে কনডম ছাড়া যৌনমিলন করলে এই ভাইরাসটি সহজেই সংক্রমিত হতে পারে।
২) সংক্রামিত রক্ত: রক্ত সংবহন বা রক্ত গ্রহণের সময় যদি সংক্রামিত রক্ত ব্যবহার করা হয়, তবে এই ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
৩) সংক্রমিত সুচ বা ইনজেকশন: যদি সংক্রমিত ব্যক্তি যে সুচ বা ইনজেকশন ব্যবহার করে, সেটি অন্য কেউ ব্যবহার করে, তাহলে তার মধ্যেও এইচআইভি প্রবেশের সম্ভাবনা থাকে।
৪) মায়ের থেকে শিশুর মধ্যে: গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময়, বা বুকের দুধের মাধ্যমে একজন সংক্রমিত মায়ের কাছ থেকে তার শিশুর মধ্যে এই ভাইরাসটি ছড়াতে পারে।
লক্ষণ
এইচআইভি সংক্রমণের প্রথম কয়েক সপ্তাহ বা মাসে কোন লক্ষণ নাও দেখা যেতে পারে, বা কিছু ক্ষেত্রে ফ্লুর মতো হালকা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে এবং ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হতে শুরু করলে বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ দেখা দিতে পারে। কিছু সাধারণ লক্ষণ হল:
– দীর্ঘমেয়াদী জ্বর
– অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস
– ক্লান্তি
– ত্বকে দাগ বা র্যাশ
– দীর্ঘমেয়াদী ডায়রিয়া
– লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া
এইচআইভি এবং এইডস
এইচআইভি এবং এইডস (AIDS – Acquired Immunodeficiency Syndrome) এক নয়, কিন্তু তারা পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। এইচআইভি হল সেই ভাইরাস যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে আক্রমণ করে, আর এইডস হল সেই অবস্থা যখন শরীরের ইমিউন সিস্টেম এতটাই দুর্বল হয়ে যায় যে, বিভিন্ন রোগ সহজেই আক্রমণ করতে পারে।
এইডস মূলত এইচআইভি সংক্রমণের শেষ পর্যায়ে দেখা যায়। যদি কেউ দীর্ঘ সময় ধরে এইচআইভি সংক্রমিত থাকে এবং সঠিক চিকিৎসা না নেয়, তবে তার ইমিউন সিস্টেম ভেঙ্গে পড়ে এবং সেই অবস্থায় তাকে এইডস আক্রান্ত বলা হয়। এইডস রোগীর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়, যেমন নিউমোনিয়া, টিউবারকুলোসিস (যক্ষা), এবং কিছু ক্যান্সার।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
এইচআইভি সংক্রমণের কোন স্থায়ী চিকিৎসা নেই, তবে উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি (যেমন অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি – ART) দ্বারা ভাইরাসটির বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধগুলি এইচআইভি ভাইরাসের সংখ্যা কমিয়ে দেয় এবং ইমিউন সিস্টেমকে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
চিকিৎসা:
১) অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (ART): এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ একসাথে ব্যবহার করা হয়, যা ভাইরাসের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে এবং রক্তে ভাইরাসের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
২) প্রি-এক্সপোজার প্রোফিল্যাক্সিস (PrEP): এই চিকিৎসা পদ্ধতি বিশেষত তাদের জন্য যারা এইচআইভি সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। PrEP হল প্রতিদিন একটি ওষুধ সেবন করা যা এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।
৩) পোস্ট-এক্সপোজার প্রোফিল্যাক্সিস (PEP): এই চিকিৎসা পদ্ধতি সেসব ব্যক্তিদের জন্য যারা সম্ভাব্যভাবে এইচআইভি সংক্রমণের পরপরই (৭২ ঘণ্টার মধ্যে) সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে চান। এটি এক মাসব্যাপী একটি ওষুধ সেবন পদ্ধতি যা ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
প্রতিরোধ:
১) নিরাপদ যৌনমিলন: কনডম ব্যবহার করে যৌনমিলন করলে এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়। এছাড়াও, একাধিক যৌনসঙ্গী থাকার পরিবর্তে একজন নির্দিষ্ট সঙ্গীর সাথে যৌনমিলন করা নিরাপদ।
২) রক্ত গ্রহণে সতর্কতা: রক্ত গ্রহণের সময় অবশ্যই সংক্রামিত রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। রক্তদান কেন্দ্রগুলিকে নিশ্চিত করতে হবে যে, রক্তগুলি এইচআইভি মুক্ত।
৩) ইনজেকশন ও সুচের ব্যবহার: ব্যবহৃত সুচ ও ইনজেকশন পুনরায় ব্যবহার করা উচিত নয়। এগুলি সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করা উচিত এবং একবার ব্যবহৃত হলে তা পুনরায় ব্যবহার করা উচিত নয়।
৪) গর্ভবতী মায়েদের জন্য চিকিৎসা: যদি একজন মায়ের এইচআইভি পজিটিভ থাকে, তবে তাকে প্রসবের সময় এবং গর্ভাবস্থায় বিশেষ চিকিৎসা দেওয়া উচিত যাতে তার শিশুর মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমিত না হয়।
এইচআইভি নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তিদের প্রায়ই সমাজে অবহেলার শিকার হতে হয়। তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় এবং তাদেরকে সামাজিকভাবে একঘরে করে রাখা হয়। তবে এটি একটি ভুল ধারণা। এইচআইভি সংক্রমণ সাধারণত দৈনন্দিন কার্যকলাপের মাধ্যমে ছড়ায় না। যেমন কোলাকুলি করা, হাত মেলানো, একই খাবার খাওয়া বা একই বাসনপত্র ব্যবহার করা ইত্যাদি দ্বারা এই ভাইরাসটি ছড়ায় না।
এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিরা সমাজের অন্যান্য লোকদের মতই সাধারণ জীবনযাপন করতে পারে, যদি তারা সঠিক চিকিৎসা এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে। তাদের প্রতি সহানুভূতি এবং সমর্থন প্রদর্শন করা উচিত, এবং সমাজকে সচেতন করতে হবে যে, এইচআইভি কোনও বিচারযোগ্য অপরাধ নয়, এটি একটি রোগ।
এইচআইভি একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা যা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে। তবে সঠিক চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। সমাজে এইচআইভি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সংক্রমিত ব্যক্তিদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।
এইচআইভি সম্পর্কে আরও গবেষণা এবং উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে আশা করা যায় যে, ভবিষ্যতে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। ততক্ষণ পর্যন্ত, প্রতিরোধ এবং সচেতনতাই এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকরী হাতিয়ার।
শিক্ষার্থী (সেশন: ২০২০-২১)
ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ







