Saturday, January 25, 2025
হোমস্বাস্থ্যনীরব মহামারী সিফিলিস !

নীরব মহামারী সিফিলিস !

সিফিলিস হল এক প্রকার যৌনবাহিত সংক্রমণ (STD), যা Treponema pallidum নামে একটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। এটি এক প্রকার বহুমাত্রিক রোগ, যা সাধারণত চারটি পর্যায়ে বিভক্ত। সিফিলিস রোগের সংক্রমণ দ্রুত ছড়ায় এবং এর প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা না করলে রোগটি দীর্ঘমেয়াদে বিপজ্জনক পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারে। বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব শতকরা ৫.৭ ভাগ। যৌনকর্মী, প্রবাসী ও বস্তিবাসী মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা দেয়। 

সিফিলিসের কারণ ও সংক্রমণ

সিফিলিসের প্রধান কারণ হল যৌন সংস্পর্শ। Treponema pallidum ব্যাকটেরিয়া প্রধানত যৌনমিলনের সময় সংক্রামিত ব্যক্তির থেকে অন্য ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করে। এটি গর্ভবতী মায়ের শরীর থেকে নবজাতক শিশুর শরীরেও স্থানান্তরিত হতে পারে, যা জন্মগত সিফিলিস হিসেবে পরিচিত। অরক্ষিত যৌনমিলন, একাধিক যৌন সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক এবং সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে সিফিলিস সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

সিফিলিসের বিভিন্ন স্টেজ ও লক্ষণ: 

সিফিলিস প্রধানত চারটি পর্যায়ে বিকশিত হয়: প্রাইমারী, সেকেন্ডারি, লেটেন্ড, এবং টারশিয়ারি স্টেজ।

১) প্রাইমারী স্টেজ: প্রাইমারী স্টেজে সিফিলিসে আক্রান্ত হলে সংক্রমণের দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণের স্থানে ছোট ক্ষত (চ্যানক্র) তৈরি হয়। এই ক্ষত সাধারণত ব্যথাহীন হয় এবং এটি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়, যদিও সংক্রমণ শরীরে থেকে যায়।

২) সেকেন্ডারি স্টেজ: প্রাইমারী স্টেজের পর সিফিলিস সেকেন্ডারি স্টেজ প্রবেশ করে, যেখানে সারা শরীরে লালচে দানা বা ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। এ সময় সর্দি-কাশি, গলাব্যথা, জ্বর, মাথাব্যথা, এবং অস্থিরতা অনুভূত হতে পারে। এই লক্ষণগুলো কয়েক সপ্তাহের জন্য বিদ্যমান থাকতে পারে এবং তারপর সেরে যায়।

৩) লেটেন্ড স্টেজ: সেকেন্ডারি স্টেজের পর সিফিলিস লেটেন্ড স্টেজে প্রবেশ করে, যেখানে সংক্রমণ সক্রিয় না থেকে গোপনে অবস্থান করে। এই পর্যায় কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং সঠিক চিকিৎসা না পেলে পরবর্তীতে তৃতীয় পর্যায়ে চলে যেতে পারে।

৪) টারশিয়ারি স্টেজ: সিফিলিসের সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায় হলো টারশিয়ারি স্টেজ। এটি ত্বক, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটি কখনো কখনো মৃত্যু ঘটাতে পারে।

সিফিলিস নির্ণয়

সিফিলিস রোগ নির্ণয় জন্য চিকিৎসক সাধারণত রক্ত এবং যেখান থেকে ঘা হয়েছে ঐ জায়গা থেকে তরল পদার্থ নিয়ে রোগ নির্ণয় করা হয়: 

১) মাইক্রোবায়োলজি টেস্ট: সাধারণ মাইক্রোস্কোপ থেকে সহজে সিফিলিস অণুজীব পাওয়া যায় না। এটা দেখার জন্য ডার্ক ফিল্ড মাইক্রোস্কোপ অথবা সিলভার স্টেনিং মাধ্যমে সিফিলিস অণুজীব দেখতে পারি। 

২) ভিডিআরএল (ভেনেরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ ল্যাবরেটরি) টেস্ট: এই টেস্ট সাধারণত স্কিনিং এর কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে এটি অনেক সময় অন্য রোগ থাকলে সেটি পজিটিভ হিসেবে গণ্য হবে। যেমন: যক্ষ্মা, সারকোইডোসিস ইত্যাদি অন্যান্য জীবাণুযুক্ত রোগ দেখা দেয়। 

৩) টিপিএইচএ (ট্রেপোনেমা প্যালিডাম পার্টিকেল অ্যাগ্লুটিনেশন অ্যাস) টেস্ট: এই টেস্ট মাধ্যমে নিশ্চিত জানা যায় যে, রোগী সিফিলিস রোগে আক্রান্ত। তবে যার একবার সিফিলিস হয়েছে, তারা যদি আরেকবার টেস্ট করাতে আসে তাহলে আজীবন পজিটিভ থাকবে। 

চিকিৎসা

সিফিলিসের চিকিৎসার জন্য মূলত পেনিসিলিন ব্যবহার করা হয়, যা সংক্রমণ দূরীকরণে অত্যন্ত কার্যকর। প্রাইমারী স্টেজে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে সিফিলিস সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা সম্ভব। তবে সেকেন্ডারি বা টারশিয়ারি স্টেজে রোগটি নিরাময়যোগ্য হলেও কিছু ক্ষেত্রে স্থায়ী ক্ষতি থেকে যায়। চিকিৎসার সময় যৌন কার্যক্রম এড়িয়ে চলা উচিত এবং যৌন সঙ্গীদের সঠিকভাবে পরীক্ষা ও চিকিৎসা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

প্রতিরোধ

সিফিলিস প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। অরক্ষিত যৌনমিলন এড়ানো, সঠিক যৌন শিক্ষার প্রসার, এবং নিয়মিত STD পরীক্ষা করানো অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও একাধিক যৌন সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

সিফিলিস একটি গুরুতর যৌনবাহিত রোগ, যা নির্দিষ্ট পর্যায়ে জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। এ রোগের দ্রুত শনাক্তকরণ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। যৌন সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে সিফিলিসসহ অন্যান্য যৌনবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব।

নাম: এস. এম. এম. মুসাব্বির উদ্দিন

সেশন: ২০২০-২১

ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ

এই সম্পর্কিত আরও আর্টিকেল দেখুন

একটি উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বাধিক পঠিত