Tuesday, February 4, 2025
হোমমহাকাশমহাকাশ: অসীম বিস্তৃতি ও মানুষের ভবিষ্যৎ

মহাকাশ: অসীম বিস্তৃতি ও মানুষের ভবিষ্যৎ

কবির এম হাসিব

ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও এর অনন্ত বিস্তৃতি আল্লাহর মহৎ সৃষ্টির উদাহরণ। কুরআনে অসংখ্যবার আসমান ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা মানবজাতিকে আল্লাহর কুদরতের সামনে বিনম্র হতে উদ্বুদ্ধ করে। মহাকাশ, আকাশের তারকা, গ্রহ, সূর্য, চন্দ্র এবং মহাবিশ্বের গঠনের গভীরতা ইসলামের চিন্তাবিদদের দীর্ঘকাল ধরে মুগ্ধ করেছে।

ইসলামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেও আমরা দেখতে পাই যে, ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেখানে মুসলিম বিজ্ঞানীরা আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে গভীর গবেষণা চালিয়েছেন। এই প্রবন্ধে ইসলামের দৃষ্টিতে মহাকাশ, তার সৃষ্টি, এবং এর সাথে সম্পর্কিত মানুষের দায়িত্বের বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে।


ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, আল্লাহ তায়ালা সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই সব কিছুর মালিক। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মহাবিশ্বের সৃষ্টির কাহিনী এবং এর বিস্তার সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। সুরা আল-আম্বিয়া (২১:৩০)-এর একটি বিখ্যাত আয়াতে বলা হয়েছে:

“যারা অবিশ্বাসী, তারা কি দেখে না যে, আসমান ও জমিন একসঙ্গে সংযুক্ত ছিল, পরে আমি উভয়কে পৃথক করেছি এবং প্রত্যেক জীবকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছি? তারা কি তবুও বিশ্বাস করবে না?”

এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে আসমান ও জমিন একসময় একটি সম্পূর্ণ ছিল এবং আল্লাহ তা পৃথক করে মহাবিশ্বের সৃষ্টি করেছেন। অনেক ইসলামিক চিন্তাবিদ এবং আধুনিক বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই আয়াতটি বিগ ব্যাং তত্ত্বের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা আধুনিক মহাবিশ্বের সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করে। বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে, যা পরবর্তীতে ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে।


মহাবিশ্বের বিস্তৃতি কুরআনে বহুবার উল্লেখিত হয়েছে। কুরআন মুসলমানদের বারবার আকাশের দিকে তাকাতে এবং আসমানের সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহর কুদরত উপলব্ধি করতে আহ্বান জানায়। যেমন, সুরা আদ-ধারিয়াত (৫১:৪৭) এ আল্লাহ বলেন:

“আমি আসমানকে আমার শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছি এবং আমি তা সম্প্রসারণ করছি।”

এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে আল্লাহ আসমানের বিস্তার ঘটাচ্ছেন, যা আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত। আজকের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। কুরআনে এরকম আয়াতগুলো মুসলিম বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেছে মহাবিশ্বের ব্যাপারে গবেষণা করতে এবং আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন খুঁজে পেতে।


আকাশ এবং পৃথিবীর সৃষ্টির প্রকৃতি কুরআনে বহুবার আল্লাহর মহানত্বের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা আল-ইমরান (৩:১৯০-১৯১) তে বলা হয়েছে:

“নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। তারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে থেকে এবং তারা আসমান ও জমিনের সৃষ্টির কথা চিন্তা করে বলে, ‘হে আমাদের রব, তুমি এসব যথার্থভাবেই সৃষ্টি করেছো।’ “

এই আয়াতগুলো আসমান ও জমিনের সৃষ্টির উপর গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য একটি আহ্বান। ইসলামের দৃষ্টিতে আকাশ এবং পৃথিবীর সৃষ্টি শুধুমাত্র আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ নয়, বরং এটি আল্লাহর প্রতি ঈমানকে আরও গভীর করার একটি উপায়।


ইসলামের স্বর্ণযুগে (৮ম থেকে ১৪শ শতাব্দী), মুসলিম বিজ্ঞানীরা জ্যোতির্বিদ্যায় অসাধারণ অবদান রেখেছিলেন। সেই সময়ে, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলিমদের অবদান গোটা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন আল-ফারগানি, ইবনে সিনা, আল-বিরুনী, এবং ইবনে আল-হাইথাম।

আল-ফারগানি ছিলেন একজন বিখ্যাত মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী যিনি নক্ষত্রের গতিবিধি এবং পৃথিবীর আকার সম্পর্কে গবেষণা করেছিলেন। ইবনে আল-হাইথাম (আল-হাজেন) ছিলেন অপটিক্স ও জ্যোতির্বিদ্যায় একজন অগ্রগণ্য বিজ্ঞানী, যিনি আলোকবিজ্ঞান এবং টেলিস্কোপের মূলনীতি তৈরি করেছিলেন। তাঁদের এসব কাজ ইসলামের জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার ঐতিহ্যের অংশ, যা আজকের জ্যোতির্বিদ্যা ও মহাকাশ গবেষণার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।


ব্ল্যাক হোলের ধারণা আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আলোর গতির চেয়েও শক্তিশালী অভিকর্ষ বলের কারণে আলোও এর ভেতর থেকে পালাতে পারে না। ইসলামিক চিন্তাবিদরা ব্ল্যাক হোলের ধারণাকে কিছুটা কুরআনের কয়েকটি আয়াতের সাথে সংযুক্ত করেন, যেখানে আসমান ও জমিনের রহস্যময় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সুরা আত-তাকভীর (৮১:১৫-১৬) তে বলা হয়েছে:

“আমি শপথ করছি সেই তারকার, যা লুকিয়ে যায় এবং আবার উদিত হয়।”

ব্ল্যাক হোলের মতো মহাকাশের রহস্যময় বিষয়গুলো মুসলমানদের জন্য আল্লাহর সৃষ্টির গভীরতার একটি নিদর্শন হতে পারে। যদিও কুরআনে সরাসরি ব্ল্যাক হোলের উল্লেখ নেই, তবে মহাবিশ্বের জটিলতা ও সৃষ্টির নিদর্শনগুলো ইসলামী চিন্তায় গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।


ইসলাম মানুষকে এই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসেবে বিবেচনা করে। মানুষের দায়িত্ব হলো এই পৃথিবী এবং মহাবিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটন করা, যেন তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সুরা আন-নাজম (৫৩:৩১) তে বলা হয়েছে:

“তোমার রবের সৃষ্টির মধ্যে যা কিছু আছে, তা তিনি ভালো করেই জানেন। আসমান ও জমিনের সকল রহস্য আল্লাহর জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত।”

মানুষের জন্য মহাকাশ অনুসন্ধান করার চেষ্টা শুধুমাত্র বিজ্ঞান নয়, বরং এটি আল্লাহর সৃষ্টির উপর গবেষণা এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি উপায়। মহাকাশের বিশালতা ও এর গভীরতা জানার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কুদরতের প্রশংসা করতে পারে এবং এই পৃথিবীর বাইরে কী আছে তা জানার চেষ্টা করে। ইসলামে গবেষণা ও জ্ঞান অর্জনের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান এবং ধর্মের সমন্বয় করেই ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগের অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল। বর্তমান সময়েও, মহাকাশ গবেষণার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির নতুন নতুন রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে।


বর্তমান সময়ে মহাকাশ গবেষণার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো মঙ্গল গ্রহে অভিযান। NASA, SpaceX, এবং অন্যান্য মহাকাশ সংস্থা মঙ্গল গ্রহে মানুষের স্থায়ী বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে। কুরআনের শিক্ষার সাথে সম্পর্ক রেখে, এই ধরনের মহাকাশ অনুসন্ধান আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে নতুন জ্ঞান আহরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। মহাকাশ ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর সৃষ্টির অসীম বিস্তৃতি এবং তাঁর ক্ষমতার প্রতিফলন। কুরআনে আসমান ও জমিনের সৃষ্টির উল্লেখ আমাদেরকে মহাবিশ্ব সম্পর্কে চিন্তা করতে এবং আল্লাহর কুদরতের প্রতি ঈমান আরও দৃঢ় করতে অনুপ্রাণিত করে। ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলিম বিজ্ঞানীরা জ্যোতির্বিদ্যা ও মহাকাশ বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন, যা আজও বিজ্ঞানী ও গবেষকদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

শিক্ষার্থী, পদার্থবিদ্যা, জগন্নাথ বিশ্বিদ্যালয়।

এই সম্পর্কিত আরও আর্টিকেল দেখুন

একটি উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বাধিক পঠিত