Monday, February 3, 2025
হোমজাতীয়সংবিধান সংস্কার: কিছু উপেক্ষিত জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়

সংবিধান সংস্কার: কিছু উপেক্ষিত জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়

খন্দকার তাসনীম।

জুলাই বিপ্লবের পর, দেশের সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় ছিল ‘সংবিধান সংস্কার’। বিশেষ করে, ১৪২ ও ৭০ অনুচ্ছেদসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দাবি ওঠে। তবে, সংবিধানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন ২৮(২) ও ৩৩(৪) অনুচ্ছেদ প্রায়ই আলোচনার বাইরে থেকে যায়, যদিও এগুলো জনগণের মৌলিক অধিকার এবং বৈষম্য সম্পর্কিত।

৩৩(৪) অনুচ্ছেদ: নিবর্তনমূলক আটক এবং মানবাধিকার

সংবিধানের ৩৩(৪) অনুচ্ছেদ সরাসরি মানবাধিকার ও নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে জড়িত। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও অবৈধ। আইনের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলেই তা আইন হয়ে যায় না। উদাহরণস্বরূপ, সংসদ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে যদি কোনো অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করে যে ‘বিকেল পাঁচটার সময় রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক সুপেয় পানি পান করতে পারবে না’ তাহলেই তা আইন হয়ে যাবে না, কারণ, তা আইনের মূলনীতির (জুরিসপ্রুডেন্স) সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

নিবর্তনমূলক আটকের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো নাগরিককে বিচারের আওতায় না এনে যত দিন ইচ্ছা তত দিন পর্যন্ত, এমনকি সারা জীবন আটক রাখার ক্ষমতা রাষ্ট্রের রয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘(৪) নিবর্তনমূলক আটকের বিধান–সংবলিত কোনো আইন কোনো ব্যক্তিকে ছয় মাসের অধিককাল আটক রাখিবার ক্ষমতা প্রদান করিবে না যদি………উপদেষ্টা-পর্ষদ উক্ত ছয় মাস অতিবাহিত হইবার পূর্বে তাঁহাকে উপস্থিত হইয়া বক্তব্য পেশ করিবার সুযোগদানের পর রিপোর্ট প্রদান না করিয়া থাকেন যে, পর্ষদের মতে উক্ত ব্যক্তিকে তদতিরিক্ত কাল আটক রাখিবার পর্যাপ্ত কারণ রহিয়াছে।’ অর্থাৎ উপদেষ্টা পর্ষদের কাছে যদি মনে হয় উক্ত ব্যক্তিকে তদতিরিক্ত কাল আটক রাখার পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে, তাহলে ছয় মাসের অধিক আটক রাখা যাবে।

৩৩(৫) অনুচ্ছেদ: তথ্য প্রকাশের উপর বিধিনিষেধ

অনুচ্ছেদ ৩৩(৫)–এর বিধান নাগরিকের মানবাধিকারের জন্য আরও ভয়ংকর। যেখানে উল্লেখ আছে ‘(৫) ……তবে শর্ত থাকে যে, আদেশদানকারী কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় তথ্যাদি-প্রকাশ জনস্বার্থবিরোধী বলিয়া মনে হইলে অনুরূপ কর্তৃপক্ষ তাহা প্রকাশে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।’ অর্থাৎ একজন ব্যক্তিকে সারা জীবন বিনা বিচারে আটক রাখার পর রাষ্ট্রের কাছে যদি মনে হয় তাকে কেন আটক রাখা হয়েছে, তা প্রকাশ করবে না, তাহলে সেই ক্ষমতাও বর্তমান সংবিধান নিশ্চিত করে।

সংবিধানের উক্ত অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও মানবাধিকার হরণকারী বিধান, যা অবশ্যই সংশোধন করতে হবে। রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এ ধরনের বিধান রাখা প্রয়োজনীয় হলেও আটক রাখার মেয়াদ সর্বোচ্চ ১৫ কিংবা ২০ দিন করা যেতে পারে এবং উক্ত সময়ের পর অপরাধে জড়িত রয়েছে মর্মে বিশ্বাসযোগ্য কারণ থাকলে তাকে অবশ্যই আদালত কর্তৃক বিচারের আওতায় আনতে হবে। তবে বাংলাদেশের মতো পারস্পরিক রাজনৈতিক অশ্রদ্ধাপূর্ণ দেশে এ ধরনের বিধান না থাকাটাই উত্তম। কারণ, ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রবর্তন হওয়ার পর থেকে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেই সরকার তাদের দলীয় স্বার্থে এই অনুচ্ছেদের অপব্যবহার করেছে।

নারীদের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা: সংবিধানে প্রয়োজন সংশোধন
২০২২ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ দশমিক ৪৫ শতাংশ নারী, যাঁদের পরিমাণ প্রায় ৮ কোটি ৫৬ লাখ এবং পুরুষের তুলনায় অধিক। অথচ বাংলাদেশের এই সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সংবিধানে অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’

বাংলা অংশটি পড়ার সময় ‘নারী-পুরুষের’ শব্দ দুটি একত্র লিখিত হওয়ায় কিছুটা অস্পষ্টতা তৈরি হলেও ইংরেজি অনুচ্ছেদটি পড়লে সহজেই সেই অস্পষ্টতা দূর হয়ে যাবে। নারীদের অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের অধিকার মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব, যেমনটি বাংলাদেশের অন্যান্য প্রচলিত আইনে সেই প্রভাবের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীরা যেখানে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিচ্ছে; লেখাপড়া, খেলাধুলা, গবেষণা, সংস্কৃতি—প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে, সেখানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার সরাসরি স্বীকৃতি না দিয়ে কেন পুরুষের অধিকার মানদণ্ড গণ্য করে নারীকে অধিকার দিতে হবে! অনেক ক্ষেত্রে যুক্তি প্রদান করা হয় যে ‘যেভাবেই লেখা হোক অধিকার তো সমান পাচ্ছে’।

অধিকার সমান পেলেও উক্ত অনুচ্ছেদের মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে ওঠে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই প্রভাব কতটা বৈষম্য সৃষ্টি করে, তা ‘দি মুসলিম ম্যারেজ এবং ডিভোর্সেস (রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট, ১৯৭৪’সহ বাংলাদেশের বিদ্যমান বিভিন্ন আইনে দেখা যায়। সংবিধান সংস্কার কমিশনকে এই অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে নারীদের স্বাধীন অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের অধিকার সংকীর্ণ হয়ে যাবে না।

সংসদ সদস্যদের দক্ষতা ও যোগ্যতা: পেশাগোষ্ঠীর আধিপত্য রোধের প্রয়োজন
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সংসদ সদস্যদের মূল দায়িত্ব আইন প্রণয়ন করা। তবে, বিগত ১৫ বছরে সংসদ সদস্যদের মধ্যে আইন বিষয়ে মৌলিক ধারণা ছিল খুবই কম। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি সংসদে অত্যাধিক ছিল, যা আইন প্রণয়নের পেশাগত ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে। সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য আইন-সংক্রান্ত ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করা প্রয়োজন, এবং সংসদ সদস্যদের আর্থিক ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা থেকে বিরত রাখার জন্য সংশোধন করা উচিত। এটি সংসদে দক্ষ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় সমন্বয় সাধন করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় সংস্কার ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।বাংলাদেশে ২০২৩ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ শিশু (০-১৪ বছর বয়সী), কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং সুরক্ষা সংক্রান্ত কোনো স্পষ্ট বিধান সংবিধানে নেই। “আজকের শিশু, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ” স্লোগান বাস্তবায়িত করতে হলে, শিশুদের সুরক্ষা এবং তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানে যথাযথ পরিবর্তন আনতে হবে। শিশু শ্রম নিরোধ এবং প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি, যাতে এই অধিকারগুলোর বাস্তবায়ন কার্যকর হতে পারে।

সুপ্রিম কোর্ট ও সংবিধানের অভিভাবকত্ব: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে কাজ করার কথা হলেও, বিভিন্ন সময়ে সরকার সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে, যার একটি উদাহরণ হল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে ৪ বনাম ৩ বিচারপতির রায়, যেখানে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছিল। এই রায়টির বিরুদ্ধে বা এর সমালোচনা করা এক প্রকার আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ নির্বাহী বিভাগের প্রভাব মুক্ত হতে হবে, যাতে বিচার বিভাগ সঠিকভাবে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশে বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে সুপ্রিম কোর্ট কখনোই সত্যিকার অর্থে সংবিধানের অভিভাবক হয়ে উঠতে পারবে না। উদাহরণস্বরূপ, গণতান্ত্রিক দেশের প্রধান বিচারপতি ‘গণভোট’কে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছিলেন। নতুন বাংলাদেশের সংবিধানে আদালতের সমালোচনার অধিকার, ‘ফেয়ার ক্রিটিসিজম’ নিশ্চিত করা উচিত এবং আইন বিভাগের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে হবে।

ক্ষমতার ভারসাম্য: বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও রাষ্ট্রপতির ভূমিকা
ক্ষমতার ভারসাম্য সাধারণত রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী’র মধ্যে আলোচনা হয়ে থাকে, তবে সঠিক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং প্রতিটি বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব মুক্ত করার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরামর্শে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া উচিত। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের দুইজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার হলে, প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের কোনোভাবে সম্পৃক্ত করা উচিত নয়।সর্বোপরি রাষ্ট্র সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও শ্রদ্ধাবোধ, যেখানে দেশপ্রেম হওয়া উচিত প্রধান চেতনা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছরের প্রায় ২৩ বছর (এরশাদ-৮ বছর, হাসিনা-১৫ বছর) স্বৈরাচারের শাসনের অধীন ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার ছিল ‘গণতন্ত্র’ এবং স্বাধীনতার পর থেকে যে রাজনৈতিক দল সবচেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবক দিয়েছে, তারাই এ দেশে দীর্ঘতম সময় স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি না হলে সংবিধানের টেকসই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। যুক্তরাজ্যের অলিখিত সংবিধান থাকা সত্ত্বেও সেখানে স্বৈরাচার তৈরি হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান পৃথিবীর অন্যতম ছোট সংবিধান, যেখানে বাংলাদেশের মতো এত বেশি অধিকারের কথা উল্লেখ করতে হয় না। অথচ সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলছে শতাব্দী ধরে।

শিক্ষার্থী, আইন অনুষদ।

এই সম্পর্কিত আরও আর্টিকেল দেখুন

একটি উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বাধিক পঠিত