প্রিয় পাঠক, দীর্ঘ এক মাস পরে হাজির হলাম গুরুত্বপুর্ণ অনেকগুলি বিষয় নিয়ে। আশা করি আমাদের এ আয়োজন আপনাদের মনে কার্যকর চিন্তার খোরাক জোগাবে। ইতিহাসের প্রতিটা স্বৈরশাসকের পতন আমাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নির্মম পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিলেও আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রের ভয়াবহ চর্চা হয়, যা শেষ হয় অভ্যুত্থান-বিপ্লবের মাধ্যমে।
ইতিহাসে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন নতুন কিছু নয়। ১৭৮৯’র ফরাসি বিপ্লব, ১৯১৭’র বলশেভিক বিপ্লব, কিংবা ১৯৭৯’র ইরানের ইসলামিক বিপ্লব ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সফলতম বিপ্লব। যার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়। এই বিপ্লবগুলো কালের সাক্ষী হয়ে স্বৈরাচারের নির্মম পতনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে আমাদের ২৪’র জুলাই বিপ্লব সম্পূর্ন ভিন্নধর্মী একতা বিপ্লব হিসেবে বিবেচিত হবে। কারন, এখানে যে বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানগুলোর কথাগুলো বললাম, সবগুলোই ছিল কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির নেতৃত্বে। আর ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিল একদল অরাজনৈতিক তরুণ শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ তথা পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে শুধু একদল শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে এত বড় বিপ্লব বিরল। এ আন্দোলনে স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র এক মাসের মতো, অথচ অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত অল্পসময়ে এত ব্যাপক আর নৃশংস রক্তক্ষয়ী বিপ্লব আর দেখা যায়নি, যেখানে হাসিনার লেলিয়ে দেয়া ছাত্রলীগ- টোকাই আর উর্দিপড়া পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-সিক্রেট এজেন্সি নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে, এমনকি পরাজয় নিশ্চিত হবার পরেও গণহত্যা করে লাশ স্তুপিকৃত করে পুলিশ ভ্যানে নিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে প্রমাণ লোপাট করতে। যা এ বিপ্লবকে আর সব বিপ্লব থেকে ইতিহাসে ব্যতিক্রম হিসেবে জায়গা দিয়েছে। এখানে সত্যিই অবাক করার মতো, আন্দোলনের শুরু থেকে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি দিচ্ছে এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য ও অনুগত হয়ে সে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছে।
শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকে ঢেলে সাজাতে হবে। শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনই নয়, এই তরুণরা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কথা বলছেন। দারুণ এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেখানে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
পাঠক, মনে রাখা দরকার, এ বিপ্লবটি শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে এখানে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছে; ধর্ম,বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে। এই বিপ্লব ছিল হাসিনার প্রতি জনক্ষোভের এক ভয়াল বহিঃপ্রকাশ, যার জন্য ঝড়েছে হাজারো প্রাণ, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন প্রায় পনেরো হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ।
বিপ্লবকে যেকোনো মূল্যে জারি রাখতে হবে, এই শহীদেরা যেন উজ্জ্বল আভা দিতে পারেন, যেন এই আহতদের মুখে হাসি ফোঁটে সত্যিকারের স্বাধীন বাংলা দেখে; আর কোনো স্বৈরাচার যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে; সেই দিকে সজাগ থাকুক ছাত্ররা।