মে মাস আসে তার দ্বিধাবিভক্ত চরিত্র নিয়ে – একদিকে শ্রমিকের রক্তাক্ত সংগ্রামের স্মৃতি, অন্যদিকে প্রকৃতির স্নিগ্ধ উপহারের সম্ভার। এই মাসটি আমাদের সামনে নিয়ে আসে একই সাথে বেদনা ও আশার চিত্র, যেখানে শিকাগোর হে মার্কেটের সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের ছায়া পড়ে আজকের বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের ক্লান্ত মুখে। আমরা যখন মে দিবসের বক্তৃতায় শ্রমিকদের মর্যাদার কথা বলি, তখন কলকারখানার ভেতরের বাস্তবতা আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় – নিরাপত্তাহীনতা, অনিয়মিত মজুরি আর স্বাস্থ্যসেবার অভাবে জর্জরিত সেই সব মানুষ যাদের হাতের পরিশ্রমে এগিয়ে যায় আমাদের অর্থনীতি।
একই সময়ে বিশ্বজুড়ে ‘মার্চ ফর গাজা’ নামে যে মানবিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় সহিংসতা আর যুদ্ধের নির্মমতা। ফিলিস্তিনি শিশুদের চোখে যে ভয় আমরা দেখি, তা কি আমাদেরই শিশুশ্রমিকদের চোখের প্রতিচ্ছবি নয়? যারা স্কুলের বেঞ্চে বসার বদলে কারখানার যন্ত্রপাতি সামলায়, তাদের জন্য আমাদের সমাজ কতটুকু ভেবেছে? এই প্রশ্নগুলো মে মাসের আলোতে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ মাসে উদ্বেগ জাগিয়েছে ভারতের সীমান্ত নীতি। বাংলাদেশ সীমান্তে তাদের নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি রোহিতদের বাংলাদেশে পাঠাতে অনিচ্ছা আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একইসাথে মার্কিন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাসের খবর বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে। যে দেশ একসময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পতাকাবাহী ছিল, সেখানে সাংবাদিকদের উপর এই দমন-পীড়ন কি বিশ্ব গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত?
ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের মধ্যে চলমান উত্তেজনা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গভীরতর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এই সংঘর্ষ কি কেবল ছাত্রদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নাকি আমাদের সমাজের বৃহত্তর অসুস্থতার প্রকাশ? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যখন রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিণত হয়, তখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা কী ধরনের বাংলাদেশ গড়ে তুলছি?
তবে মে মাস শুধু সংকটই নয়, আনন্দও বয়ে আনে। লটকনের টক-মিষ্টি স্বাদ যেমন আমাদের জিভে জল আনে, তেমনি এই ছোট ফলটি আমাদের প্রকৃতির অফুরন্ত দানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই সহজ-সরল উপহারই যেন বলে দেয়, জীবন কতটা সুন্দর হতে পারে যদি আমরা প্রকৃতির সাথে সাযুজ্য বজায় রাখি।
মে মাস শেষ হয় আমাদের জন্য এক গভীর চিন্তা রেখে যায় – শ্রমিকের অধিকার, শিশুর নিরাপত্তা, প্রকৃতির সুরক্ষা এবং শিক্ষার সুযোগ সবই এক সূত্রে গাঁথা। এই মাসটি আমাদের শুধু স্মরণ করায় না, জাগ্রত করে ভাবতে, প্রশ্ন করতে এবং পরিবর্তনের জন্য দাঁড়াতে। কারণ মে মাস কেবল ক্যালেন্ডারের একটি পাতার নাম নয়, এটি বিবেকের ডাক, সময়ের দাবি এবং ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার।
