শরফুদ্দীন আহমেদ
‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ খ্যাত কবি; বাংলা কে সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ও ৮০-এর দশকের খ্যাতিমান কবি আসাদ বিন হাফিজ (৬৬) পহেলা জুলাই মহান রবের দরবারে পাড়ি জমিয়েছেন। আর আগের কয়েক দিন ধরেই তিনি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। রোববার সন্ধ্যার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় শোকে ভেঙে পড়েন তার ভক্ত-অনুরাগীরা। দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যুর সংবাদ ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। এ সংবাদে তার অনুরাগী অগণিত পাঠক, কবি, সাহিত্যিক ও সাস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। খাতিম্যান এই কবি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। পরদিন জোহর নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
নামাজে জানাজা শেষে তার লাশ নিজ গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার মোক্তারপুর ইউনিয়নের বড়গাঁও গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আসরের নামাজের পর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বড় ভাই অধ্যাপক ইউসুফ আলীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
প্রিয় কবি ১৯৫৮ সনের ১ জানুয়ারি গাজীপুরের কালীগঞ্জের মোক্তারপুরের বড়গাঁও এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি নিজ গ্রাম বড়গাঁও প্রাইমারি স্কুলে এবং বাড়ির পাশের
মক্তবে আরবি শেখেন। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৮৩ সালে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তা’মীরুল মিল্লাত মাদরাসায়। পরে মানারাত স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলার প্রভাষক পদে যোগদান করেন। এছাড়াও তিনি মাসিক পৃথিবী পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক, সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর পরিচালক, বাংলা সাহিত্য পরিষদের নির্বাহী, প্রীতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন।
কবি ফররুখ আহমেদের অনুসারী কবি আসাদ বিন হাফিজ ছোটবেলা থেকেই ইসলামিক সাংস্কৃতিক চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি তার সাহিত্যে বাংলার মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণ এবং বিপ্লবের অনুপ্রেরণা প্রকাশ করেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সৃজনশীলতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহারেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার সাহিত্যে বিপ্লবী চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটে। তিনি ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন।
কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, গবেষণা, সম্পাদনাসহ সাহিত্যের সব শাখাতেই তিনি অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার লেখা প্রায় ৮১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘কি দেখো দাঁড়িয়ে একা সুহাসিনী ভোর’ এবং ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’।
কবির সাহিত্য রচনার ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল, দুর্বোধ্যতামুক্ত। এ কবির কাব্যসৌধ গড়ে উঠেছে সুবোধ্যতার ভিতের ওপর। কবির শ্রেষ্ঠ রচনা হল ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’। এই গ্রন্থে কবিতা ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ কবিতাটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের মধ্যেই একটি অন্যতম সেরা কবিতা। তিনি যে-সমাজের স্বপ্ন দেখেন তার অসাধারণ এক কাব্যিক রূপ দিয়েছেন এই কবিতায়। যা বাংলা সাহিত্যে আর কোনো কবির কলমে এ রকমভাবে ফুটে উঠেনি। তার এ কবিতার কয়েকটি চরণ-
“আমি আপনাদেরকে আরেকটি অনিবার্য বিপ্লবের জন্য
প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি।
বিপ্লবে প্রতিটি নাগরিকের জীবন হয় যে
একেকজন যোদ্ধার জীবন
প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি মানুষ হয়
একেকজন আমূল বিপ্লবী
প্রতিটি যুবক
নারীর বাহুর পরিবর্তে স্বপ্ন দেখে উত্তপ্ত মেশিনগানের
আর রমণীরা
সুগন্ধি রুমালের পরিবর্তে পুরুষের হাতে তুলে দেয়
বুলেট, গ্রেনেড।”
উপরিউক্ত চরণগুলোতে কবির সাহিত্যিক দ্যোতনা প্রকাশ পেয়েছে। আবার কবির আদর্শের বিপ্লবের ব্যঞ্জনা ধ্বনিত হয়েছে নিম্নোক্ত চরণগুলোতে-
“আমি আমার জনগণকে
আসন্ন সেই বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান
জানাচ্ছি।
যেখানে অন্ধকার
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে ক্লেদাক্ত পাপ ও পঙ্কিলতার সয়লাব সেখানেই বিপ্লব
যেখানে নগ্নতা ও বেহায়াপনার যুগল উল্লাস
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে মিথ্যার ফানুস
সেখানেই বিপ্লব
বিপ্লব সকল জুলুম, অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিপ্লব অন্তরের প্রতিটি কুচিন্তা আর কুকর্মের বিরুদ্ধে।”
কাব্যগ্রন্থঃ ১. কি দেখো দাঁড়িয়ে একা সুহাসিনী ভোর (১৯৯০) ২. অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার (১৯৯৬) শিশুতোষ গ্রন্থঃ ১. হরফ নিয়ে ছড়া (১৯৮৯) ২. আলোর হাসি ফুলের গান (১৯৯০) ৩. কুক কু রুকু (১৯৯২) ৪. ইয়াগো মিয়াগো (১৯৯৪) ৫. আল্লাহ মহান (২০০১) ৬. কারবালা কাহিনী (২০০১) অনুবাদ কাব্যগ্রন্থঃ ১. নাতিয়াতুন নবী (২০০৩) ছড়াঃ ১. রাজনীতি ধুমধাম (১৯৮০) ২. হিরালালের ছড়া (২০০৩) গবেষণা গ্রন্থঃ ১. আল-কুরআনের বিষয় অভিধান (১৯৯২) ২. ইসলামী সংস্কৃতি ৩. ছন্দের আসর ঐতিহাসিক গ্রন্থঃ ১. ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস (১৯৯০) গল্প গ্রন্থঃ ১. পনেরই অগাস্টের গল্প (১৯৯০) জীবনী গ্রন্থঃ ১. আপোষহীন এক সংগ্রামী নেতা (১৯৯২) ২. নাম তার ফররুখ (১৯৯৭) কিশোর সাহিত্য সম্পাদনাঃ ১. নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন (১৯৯২) ২. আলোর পথে এসো (১৯৯৯) ঐতিহাসিক দুঃসাহসিক অভিযান সিরিজঃ ১. গাজী সালাউদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান (১৯৯৭) ২. সালাউদ্দীনের কমান্ডো অভিযান (১৯৯৭) ৩. সুবাক দুর্গে আক্রমণ (১৯৯৭) ৮. ভয়ংকর শিরযন্ত্র (১৯৯৭) ৯. ভয়াল রজনী (১৯৯৮) ১০. আবারো সংগ্রাম (২০০০) ১১. দুর্গ পতন (২০০০) ১২. ফেরাউনের গুপ্তধন (২০০১) ১৩. উপকূলে সংঘর্ষ (২০০১) ১৪. সর্প কেল্লার খুনী (২০০১) ১৫. চারিদিকে চক্রান্ত (২০০২) ১৬. গোপন বিদ্রোহ (২০০২) ১৭. পাপের ফল (২০০২) ১৮. তুমুল লড়াই (২০০২) ১৯. উফ্র দরবেশ (২০০২) ২০. টার্গেট ফিলিস্তিন (২০০২) ২১. গাদ্দার (২০০৩) ২২. বিষাক্ত ছোবল (২০০৩) ২৩. খুনী চক্রের আস্তানায় (২০০৩) ২৪. পাল্টা ধাওয়া (২০০৩) ২৫. ধাপ্পাবাজ (২০০৪) ২৬. হেমস এসর যোদ্ধা (২০০৪) ২৭. ইহুদী কন্যা (২০০৪) ২৮. সামনে বৈরুত (২০০৪) ২৯. দূর্গম পাহাড় (২০০৪) ৩০. রক্তাক্ত মরুভূমি (২০০৪) ৩১. ছোট বেগম (২০০৬) ৩২. রক্তস্রোত (২০০৬) ৩৩. যাযাবর কন্যা (২০০৬) ৩৪. মহাসমর (২০০৬)
কবি আসাদ বিন হাফিজ তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কলম সেনা পুরস্কার (১৯৯৪), কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এমইউ আহমেদ পুরস্কার (১৯৯৭), বাংলাদেশ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ পুরস্কার (১৯৯৭), ছড়ার ডাক পদক ও সম্মাননা (২০০৪), মেলোডি শিল্পীগোষ্ঠী পদক (২০০৪), কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৪), গাজীপুর সংস্কৃতি পরিষদ কৃতী সংবর্ধনা (২০০৪), মরহুম ওমর ফারুক সম্মাননা স্মারক ‘কাব্যরত’ ২০১৬ ও সাহিত্যচর্চা সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
বাংলা ও ইসলামী সাহিত্যে তার অবদান অতুলনীয়।
খ্যাতিমান, বিশ্বাসী কবি ও সাহিত্যিক আসাদ বিন হাফিজের ইন্তেকালে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিক সংগঠন গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। দ্যা ক্যাম্পাস মিরর পরিবারও গভীর শোক প্রকাশ করে রূহের মাগফিরাত কামনা করছে।
-লেখক
সম্পাদনা সহযোগী
দ্যা ক্যাম্পাস মিরর