আব্দুল্লাহ আল মারুফ
সাগরকন্যা কুয়াকাটা থেকে অল্প একটু দূরেই ফাতরার বনের অবস্থান। পর্যটকদের জন্য ক্রমশ আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হচ্ছে ফাতরার বন, যা স্থানীয় ভাষায় ফাতরার চর নামে পরিচিত। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেষে বেড়ে ওঠা এই বনকে অনেকে দ্বিতীয় সুন্দরবন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ম্যানগ্রোভ বনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ফাতরার বনে উপস্থিত। যান্ত্রিক কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে ফাতরার বনের নীরবতা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আমরা সাগরকন্যা কুয়াকাটা যাওয়ার পরে ফাতরার বনের নাম শোনা। মূলত সুন্দরবনেরই একটি অংশ পটুয়াখালীর এই অংশে এসে নাম নিয়েছে ফাতরার চর। সফরসঙ্গী এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে শুনে বিকেলে কুয়াকাটা সী-বিচ থেকে অটোরিকশায় ফাতরার বনের উদ্দেশ্যে রওনা হই। জোয়ার থাকায় বনের গভীরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। চরেই অবস্থান করি। লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যাই। সাথে সমুদ্রের কলকল ধ্বনি প্রশান্তির ভিন্ন মাত্রা যোগ করছে।
কুয়াকাটা সী-বিচ থেকে ট্রলার যোগে বনের গহীনে যাওয়া যায়। বনের গভীরে গেলে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে সুন্দরী, কেওড়া, বাইন, গোলপাতাসহ আরো বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের দেখা মেলে। নানা প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দে বিমোহিত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সরীসৃপের দেখা মেলে। দিনে দু’বার এটি জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয়। চরের পূর্ব অংশে রয়েছে একটি ছোট সমুদ্র সৈকত। এখানে যেতে হলে সবুজ অরণ্য আর কয়েকটি ছোট খালের ওপরে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে যেতে হবে। তবে দৃষ্টিনন্দন এই চরটিতে এখনো পর্যটকদের জন্য থাকার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তবে বন বিভাগের কোনো কর্তাব্যক্তির অনুমতি সাপেক্ষে থাকা যাবে ওই রেস্টহাউজে। কেবল নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ভ্রমণ করা যায় ফাতরার চরে।
ফাতরার চরে আমরা যখন অবস্থান করি তখন প্রায় বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা গড়াচ্ছে। আকাশের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। বৃষ্টি আসার আশংকা ছিল। ছোট্ট সী-বিচে ঘোড়সওয়ার কয়েকজন ঘোড়া নিয়ে ছোটাছুটি করছে রোজগারের আশায়। কয়েকজন ছোট ছেলেমেয়ের দেখা মেলে। গল্প করে জানতে পারি তারা স্থানীয় জেলে পাড়ার বাসিন্দা। লাল কাঁকড়া ধরে পর্যটকদের নিকট বিক্রি করে বা টাকার বিনিময়ে ছবি তুলতে দেয়। এর জন্য নির্দিষ্ট কোন টাকা নেই, যার খুশিমতো যা দেয়।
সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত উপভোগ করতে পারবেন ফাতরার চর থেকে। সাধারণত শীতের মৌসুমে ফাতরার বনে পর্যটকদের উপস্থিতি বেশি লক্ষ করা যায়। সড়কপথে যাতায়াতের মাধ্যম আরও সহজতর হলে পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
পটুয়াখালী জেলার সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্যমতে,আন্ধারমানিক নদীর মোহনার পশ্চিম দিকে রয়েছে সুন্দরবনের শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল, নাম তার ফাতরার বন যা বইয়ের ভাষায় টেংরাগিরি বনাঞ্চল নামেও পরিচিত। ভৌগোলিকভাবে বরগুনা জেলায় বাগানটির অবস্থান থাকলেও কুয়াকাটায় আগত পর্যটকরা বিনোদনের জন্য সেখানে ট্রলার যোগে যাতায়াত করেন। তবে সুন্দরবনের অংশ হলেও এ বনে নেই তেমন কোন হিংস্র প্রাণী। ৯,৯৭,৫০৭ একর জুড়ে এই বনের পরিধি। সাধারণত বনরক্ষী ছাড়া এখানে স্থায়ী বাসিন্দা নেই।
যেভাবে যাবেন ফাতরার বন:
ফাতরার চর দেখতে হলে প্রথমে কুয়াকাটা আসতে হবে। কুয়াকাটা থেকে প্রতিদিন বেশকিছু ট্রলার জনপ্রতি ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা ভাড়ায় (ভাড়া সিজনের উপর নির্ভর করে) ফাতরার চরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। অথবা ট্রলার রিজার্ভ নিয়েও ২ ঘন্টায় ফাতরার বনে পৌঁছাতে পারবেন। নদী ও সড়ক পথে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যাওয়া যায়। লঞ্চে ঢাকা সদরঘাট থেকে পটুয়াখালী বা বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা। আর বাসে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা। তবে সবচেয়ে সহজ ও আরামের কথা বিবেচনা করলে কুয়াকাটা যেতে নদী পথই উত্তম। ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে লঞ্চে করে পটুয়াখালীতে গিয়ে সেখান থেকে বাসে করে কুয়াকাটা যাওয়া যায়। অথবা লঞ্চে সদরঘাট থেকে বরিশাল গিয়ে সেখান থেকে বাসে কুয়াকাটা যেতে পারবেন।
সদরঘাট থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পটুয়াখালি যাবার লঞ্চ ছেড়ে যায় এবং সকাল ৭টার দিকে পটুয়াখালি পৌছায়। লঞ্চ ভাড়া ডেক ৪০০-৫০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ১৩০০ টাকা, ডাবল কেবিন ২৪০০ টাকা, ভি আই পি কেবিন ভাড়া ৭০০০ টাকা। পটুয়াখালী লঞ্চ ঘাট থেকে অটোতে বাস স্ট্যান্ড গিয়ে লোকাল বাসে যেতে হবে কুয়াকাটা। যেতে সময় লাগবে ২ঘন্টার মত, আর বাস ভাড়া ১৫০-১৬০ টাকা। এছাড়া সদরঘাট থেকে সন্ধ্যার পর বরিশালের উদ্দেশ্যে একাধিক লঞ্চ ছেড়ে ভোরে বরিশাল পৌঁছায়। বরিশাল লঞ্চঘাট থেকে রূপাতলি বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে কুয়াকাটা যাবার বাস পাওয়া যায়। বাসে যেতে সময় লাগবে ৩ ঘন্টার মত, বাস ভাড়া ১৮০-২৫০ টাকা।
থাকবেন কোথায় :
ফাতরার বন বা চর কেন্দ্রিক এখনো হোটেল মোটেল বা রিসোর্ট তৈরি হয়নি। এক্ষেত্রে আপনাকে থাকতে হবে কুয়াকাটায়। মানের উপর ভিত্তি করে হোটেলের রুম বুকিং করতে হবে। দামাদামি করে নিলে ভালো হয়। সচরাচর পর্যটন মৌসুমে রুম খালি থাকে না। এছাড়া প্রায় রিসোর্ট গুলোর রুম খালি পাবেন।
খাবার-দাবার:
খাবারের কথা বললে সেই আবাসনের বিষয়টা উঠে আসে। ফাতরার চরে এখনো সেভাবে গড়ে উঠেনি খাবার হোটেল। এক্ষেত্রে আপনি বা আপনাদেরকে খাবার নিয়ে যেতে হবে। চাইলে চরে গিয়ে পিকনিক করতে পারেন।
সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যথাযথ দেখভাল হলেই ফাতরার বন কেন্দ্রিক একটি সুন্দর পর্যটন শিল্প গড়ে উঠবে। এতে সরকার রাজস্ব পাবে। সাথে অনেক মানুষের জীবিকার খাত তৈরি হবে। এবিষয়ে সরকারের আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।