মিরর ডেস্ক।
গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি নতুন করে জোরদার হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা এই দাবিতে সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেছে, যা সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে। এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচনের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর আগে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়ে ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
পাকিস্তান আমল থেকেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর এই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর গণতান্ত্রিক সরকারগুলোও এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া পুনঃস্থাপন করেনি। ফলে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখার জন্য দখলবাজি চালিয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো প্রায় পুরোপুরি ক্যাম্পাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্রলীগ শুধু ক্যাম্পাস থেকে নয়, আইনি দৃষ্টিতেও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।গত ৩৪ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন মাত্র একবার, ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে সেই নির্বাচনও সরকার-সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের একগুঁয়েমি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্লজ্জ পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকার কারণে কার্যকর হতে ব্যর্থ হয়।
বর্তমান পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে তীব্র বিরোধ দেখা যাচ্ছে। একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনপ্রক্রিয়া ব্যাহত করার অভিযোগ তুলছে সংগঠনগুলো। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে এখন স্পষ্টভাবে বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ধরনের বিরোধ আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা দিয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এখানে একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠে আসে—যে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং ছাত্রসংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে ভূমিকা রেখেছে, তারা কেন ডাকসু এবং অন্যান্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে একমত হতে পারছে না? এই বিভেদ ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত যত দ্রুত সম্ভব ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। নীতিমালা প্রণয়নের নামে অযথা সময়ক্ষেপণ শিক্ষার্থীরা মেনে নেবে না।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ নেই। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবলিক কলেজগুলোতেও এই দাবির প্রতি সমর্থন বাড়ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত সোমবার আয়োজিত এক সেমিনারে নতুন প্রজন্মের এক রাজনীতিক সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।

এই বাস্তবতায়, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষার্থীদের দাবি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করা।শুধু ডাকসু নয়, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। একই সঙ্গে কলেজগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়েও যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যদি আমরা সত্যিই যোগ্য ও দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চাই, তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কোনো বিকল্প নেই।
যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের বিধান রয়েছে, সেখানে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই নিতে পারে। তবে কলেজগুলোর ক্ষেত্রে এটি নির্ভর করবে সরাসরি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।
দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্বের অভাব যে প্রকট হয়ে উঠেছে, তার প্রধান কারণ হলো ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ থাকা। শুধু জাতীয় নেতৃত্ব তৈরিই নয়, শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায় এবং শিক্ষাঙ্গনে একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান থাকবে, তারা যেন এমন কোনো পদক্ষেপ না নেয় যা ছাত্র সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করে। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই একটি সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব।ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল শিক্ষার্থীদের অধিকার নয়, এটি একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্যতম স্তম্ভ। দীর্ঘদিন ধরে এই নির্বাচন বন্ধ থাকায় শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার অভাব স্পষ্ট হয়েছে, যা জাতীয় রাজনীতিতে যোগ্য নেতৃত্বের সংকট তৈরি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে। শিক্ষার্থীরা সভা-সমাবেশ এবং বিক্ষোভের মাধ্যমে তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত দেরি না করে যথাসম্ভব দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
বিশেষ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন ঘিরে যে আলোচনা চলছে, তা শুধু এই প্রতিষ্ঠানের নয়, গোটা দেশের ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের গঠিত কমিটির সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এমনকি অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবির জোরালো প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের উচিত নিজস্ব ক্ষমতার মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া। অন্যদিকে, কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য সরকারের সরাসরি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির জন্য নয়, শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া পূরণ এবং শিক্ষাঙ্গনে একটি গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের নীতিমালা প্রণয়ন বা প্রস্তুতির নামে সময়ক্ষেপণ শিক্ষার্থীরা মেনে নেবে না। সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিও আহ্বান থাকবে, তারা যেন নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়—এমন কোনো পদক্ষেপ না নেয়।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন শিক্ষার্থীদের জন্য গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ এবং দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তোলার পথ। সময় এসেছে এই দাবিকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে একটি সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার।