ক্ষমতাবান রাজা বাদশাহরা অনেক সময় নিজেদের হারেমে প্রচুর নারী রাখতেন, যাদের মূলত উপভোগের উদ্দেশ্যে রাখা হতো। এসব নারীদের ‘রক্ষিতা’ বলা হতো। প্রাচীন চীনে হারেমে প্রায় ২০ হাজার নারী ছিল। রক্ষিতা রাখার মূল কারণ ছিল জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল বেশি সন্তান উৎপাদন করা, যাতে রাজকীয় রক্তে অধিক পরিমাণ উত্তরাধিকারী জন্মায় এবং রাজ পরিবার কখনো বিলুপ্ত না হয়।
এই নারীদের অনেক সময় জোর করে ধরে আনা হতো কিংবা পরিবার থেকে ছিনিয়ে আনা হতো। তাদের যাতে পালিয়ে যেতে না পারে বা ভেতরে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয়, তাই পাহারাদার রাখা হতো। তবে এখানে একটি সমস্যা ছিল, কারণ পাহারাদার হিসেবে যারা পুরুষ থাকতেন, তাদের মধ্যে অনেকেই রক্ষিতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ফেলতেন।
রক্ষিতাদের ঔরসে শুধুই রাজ রক্তের উত্তরাধিকার তৈরি হবার পাশাপাশি বাইরের রক্ত মিশ্রিত হয়ে যাবার একটা ভয় থেকেই যায়। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য রাজারা একটা পথ বেছে নেয়। পাহারাদারদের যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া। যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেবার প্রক্রিয়াকেই বলে খোজাকরণ। যাদের যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া হয় তাদের বলে ‘খোজা’। ইংরেজি Eunuch শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে খোজা। ইউনাক শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Eunoukhos থেকে, যার অর্থ শয়নকক্ষের পাহারাদার।
প্রাচীন চীনের রাজসভা এবং সামাজিক ব্যবস্থার এক অন্ধকার দিক ছিল খোজাকরণ (Eunuch System)। খোজাকরণ বলতে এমন প্রথাকে বোঝানো হয়, যেখানে পুরুষদের যৌনাঙ্গ অপসারণ করে রাজসভায় বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চাকরির জন্য প্রস্তুত করা হতো। এই নিষ্ঠুর প্রথা হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চীনা সমাজে প্রচলিত ছিল এবং বিভিন্ন রাজবংশের অধীনে এর ভয়াবহ রূপ দেখা যায়।
খোজাকরণের প্রচলন চীনে প্রায় ৩,০০০ বছর আগেও ছিল বলে ধারণা করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১০৪৬ অব্দ পর্যন্ত শাং রাজবংশের (Shang Dynasty) আমলে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে এটি বৃহৎ পরিসরে চালু হয় হান রাজবংশ (Han Dynasty, ২০২ খ্রিস্টপূর্ব – ২২০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে।
খোজাকরণের মূল কারণ ছিল:
রাজসভার বিশ্বস্ত চাকর: রাজপরিবারে চাকরি পেতে হলে পুরুষদের খোজা হতে হতো, যাতে তারা রানী, উপপত্নী এবং রাজকন্যাদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারে।
শাস্তি হিসেবে: কিছু ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে তাদের খোজা করে দাসত্বে বাধ্য করা হতো।
উন্নতির পথ: দরিদ্র পরিবার থেকে অনেকেই রাজসভায় ভালো অবস্থান পাওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় খোজাকরণ করত।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে: খোজা পুরুষরা সরাসরি রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠত, যা রাজনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়তা করত।




খোজাকরণের প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং বিপজ্জনক। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, খোজাকরণ করার সময় পুরুষের পুরুষাঙ্গ সম্পূর্ণভাবে কেটে ফেলা হতো। এই প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কষ্টদায়ক এবং প্রায়শই সংক্রমণের কারণে মৃত্যু হতো।
প্রক্রিয়াটি নিম্নরূপ ছিল:
একজন ব্যক্তি রাজসভায় চাকরির জন্য খোজাকরণে সম্মতি দিলে, তাকে প্রথমে এক নির্দিষ্ট ঘরে রাখা হতো।
এরপর অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করা হতো। সাধারণত স্থানীয় হাতুড়ে চিকিৎসকরা এটি সম্পন্ন করত।
কোনো রকম অবেদনহীন অবস্থায় ধারালো ছুরি দিয়ে পুরুষাঙ্গ সম্পূর্ণভাবে কেটে ফেলা হতো।
রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ওষুধের পরিবর্তে কখনও কখনও গরম তেল বা ছাই ব্যবহার করা হতো।
সফলভাবে বেঁচে গেলে, তাকে কয়েক মাস পর রাজসভায় চাকরির জন্য নেওয়া হতো।
খোজাকরণের ফলে একজন ব্যক্তি যৌন ক্ষমতা হারালেও, তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ থাকত। ফলে চীনের রাজসভার খোজারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবস্থান করত।
প্রধান প্রশাসনিক দায়িত্ব: রাজপরিবারের ব্যক্তিগত সহকারী, উপদেষ্টা ও কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করত।
গোপন তথ্যের রক্ষক: খোজারা সরাসরি সম্রাটের কাছে থাকত, ফলে তারা অনেক গোপন তথ্য জানত।
রাজপরিবারের সুরক্ষা: রাজপরিবারের মহিলাদের দেখাশোনা করত এবং তাদের চাহিদা পূরণ করত।
ক্ষমতার দখল: কিছু ক্ষেত্রে খোজারা রাজপরিবারকে নিয়ন্ত্রণ করত এবং সম্রাটের ক্ষমতার ছায়া হয়ে উঠত।
প্রাচীন চীনে অনেক খোজা পুরুষ ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এদের মধ্যে কয়েকজন হল:
প্রাচীন চীনে কিছু এমন ব্যক্তিত্বের উত্থান হয়েছিল, যাদের কর্মকাণ্ড ও প্রভাব ইতিহাসে গভীর ছাপ ফেলেছে। তাদের মধ্যে জাং রাং, ওয়েই ঝংসিয়ান এবং চেং হো উল্লেখযোগ্য। এই নিবন্ধে আমরা এই তিন ব্যক্তির জীবনী, তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব, এবং চীনা সমাজ ও রাজনীতিতে তাদের অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
জাং রাং (Zhang Rang):
জাং রাং ছিলেন পূর্ব হান রাজবংশের শেষ পর্যায়ের একজন ক্ষমতাশালী কৌঁসুলি। তার প্রভাব এতটাই বৃদ্ধি পায় যে সম্রাটও তার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারতেন না। জাং রাংয়ের শাসনামলে দুর্নীতি ও অরাজকতা বেড়ে যায়, যা রাজবংশের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ওয়েই ঝংসিয়ান (Wei Zhongxian):
মিং রাজবংশের আমলে, ওয়েই ঝংসিয়ান ছিলেন একজন ক্ষমতাশালী কৌঁসুলি। তার শাসনামলে তিনি প্রায় পুরো সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং তার নিষ্ঠুরতার জন্য তিনি ভয়ানক feared ছিলেন। ওয়েই ঝংসিয়ানের শাসনামলে দুর্নীতি ও অরাজকতা বেড়ে যায়, যা মিং রাজবংশের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
চেং হো (Zheng He):
চেং হো ছিলেন মিং রাজবংশের বিখ্যাত নৌ-অভিযাত্রী। তিনি বিশাল সমুদ্র অভিযান পরিচালনা করেন, যা চীনের বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চেং হোয়ের অভিযানে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়, যা চীনের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।
এই তিন ব্যক্তিত্বের কর্মকাণ্ড ও প্রভাব প্রাচীন চীনের ইতিহাসে গভীর ছাপ ফেলেছে। তাদের জীবন ও কর্ম চীনা সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখেছে, যা আজও পাঠ্য ও গবেষণার বিষয়।
চীনের সাধারণ জনগণ খোজাদের প্রতি মিশ্র মনোভাব পোষণ করত। যদিও তারা রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করত, তবুও সমাজের অন্যান্য অংশে তাদের অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হতো। খোজাদের অনেকেই উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হলেও তারা সামাজিকভাবে অবাঞ্ছিত হিসেবে গণ্য হতো।
১৯১২ সালে কুইং রাজবংশের (Qing Dynasty) পতনের পর চীনে আনুষ্ঠানিকভাবে খোজাকরণ নিষিদ্ধ করা হয়। শেষ খোজাকৃত পুরুষের নাম ছিল সুয়ান জি (Sun Yaoting), যিনি ১৯৯৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রাচীন চীনের খোজাকরণের ইতিহাস ছিল এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার গভীর অসঙ্গতি প্রকাশ করে। রাজসভার অভ্যন্তরে এই খোজারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করলেও, তাদের জীবন ছিল অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও দুর্বিষহ। সময়ের বিবর্তনে এই প্রথা বিলুপ্ত হলেও, ইতিহাসে এটি এক ভয়াবহ নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
লেখক,
সহকারী সম্পাদক, দ্যা ক্যাম্পাস মিরর।