Tuesday, March 18, 2025
হোমবই রিভিউমাই নেম ইজ রেড

মাই নেম ইজ রেড

সাদী মোহাম্মদ সাদ

নোবেল বিজয়ী তুর্কি সাহিত্যিক ওরহান পামুক বিশ্ব সাহিত্যে এক অনন্য নাম। তিনি একজন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক, চিত্রনাট্য সম্পাদক এবং শিক্ষক। ২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভের পর তার খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, যদিও মূলধারার পাঠকদের কাছে তিনি তার লেখালেখির শুরু থেকেই পরিচিত। বর্তমান সময়ে অন্যতম জনপ্রিয় এই লেখকের বই প্রায় ৬০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ১ কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।

ওরহান পামুকের সাহিত্য শুধু পাঠকের হৃদয় জয় করেনি, বরং দেশ-বিদেশে বহু পুরস্কারও অর্জন করেছে। তুরস্কের ইতিহাসে তিনি অন্যতম জনপ্রিয় এবং সর্বাধিক পুরস্কৃত লেখকদের একজন হিসেবে বিবেচিত হন।

১৯৭৪ সালে লেখালেখির পথচলা শুরু করা পামুক ছাত্রজীবনে প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়ন করলেও পরে তা ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। তার লেখা প্রতিটি উপন্যাসই বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে নতুন বই প্রকাশের জন্য পাঠকদের দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়, কারণ তিনি বারবার সম্পাদনায় বিশ্বাসী। প্রতিটি উপন্যাস লেখার পর পামুক সেটি বহুবার সম্পাদনা করেন, ফলে তার নতুন গ্রন্থ প্রকাশের সময় তুলনামূলক দীর্ঘ হয়।

ওরহান পামুকের উপন্যাস ‘মাই নেম ইজ রেড’ তার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে তুরস্কে এবং ২০০১ সালে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। এটি শুধুমাত্র একটি উপন্যাস নয়; এটি একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং মানবিক অভিজ্ঞতার বিস্তৃত চিত্র। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসে পামুক এমন এক পৃথিবীর কথা বলেন, যেখানে শিল্প, ধর্ম, রাজনীতি এবং ভালোবাসা গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।

‘মাই নেম ইজ রেড’ এর কাহিনি শুরু হয় একটি চিত্রশিল্পীর মৃত্যু দিয়ে। এই চিত্রশিল্পী একটি কুয়োর তলায় পড়ে রয়েছে, আর তার মৃত দেহ থেকেই গল্পের সূচনা। খুনী কে, সে কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটালো এবং এর সাথে সাম্রাজ্য ও চিত্রকলার ঐতিহ্য কীভাবে সম্পর্কিত, এই প্রশ্নের উত্তরই গল্পটির প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে। পুরো উপন্যাসটি বিভিন্ন চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণিত হয়েছে। মোট ৫৯টি অধ্যায়ে প্রত্যেক চরিত্র নিজের বয়ানে গল্পের অংশ তুলে ধরে। চিত্রশিল্পী, খুনী, সুলতান, একটি গাছ, এমনকি একটি লাল রঙও এই উপন্যাসে কথা বলে, যেমন গাছটি বলে, “আমি একে একে সবকিছু দেখেছি, কিন্তু আমার একদিনই অনুভব হয়েছে, আমি শুধু একজন শিল্পীর জন্যই জন্মেছি।”। এই স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গিগুলো উপন্যাসকে অসাধারণ একটি শৈল্পিক কাঠামো দেয়।

অটোম্যান সাম্রাজ্যের সুলতান তার জীবন এবং রাজত্বকাল সম্পর্কে একটি সচিত্র পাণ্ডুলিপি তৈরি করার আদেশ দেন। এর জন্য নিযুক্ত হয় সুলতানের সেরা চিত্রশিল্পীরা। কিন্তু কাজটি সহজ ছিল না। তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকট হয়, কারণ তাদেরকে মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী অনুচিত্র শিল্পের নিয়ম থেকে সরে এসে ইউরোপীয় শৈলীতে কাজ করতে হয়। এই সাংস্কৃতিক সংঘাত শিল্পীদের মধ্যে গভীর ফাটল তৈরি করে। সেই সঙ্গে চিত্রশিল্পীদের একটি অংশ উগ্রপন্থীদের দ্বারা চিত্রকলার বিরুদ্ধে ধর্মীয় ফতোয়ার মুখোমুখি হয়। 

উপন্যাসে লাল রঙের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। চিত্রশিল্পীরা যখন তাদের আঁকা ছবিতে লাল রঙ ব্যবহার করে, তখন তা শুধু একটি রঙ নয়, বরং তাদের জীবনের এবং তাদের পৃথিবীর একটি গভীর প্রতীক হয়ে ওঠে। লাল রঙের মাধ্যমে শিল্পীরা তাদের নিজস্ব আবেগ, খুনের প্রতিশোধ এবং সাংস্কৃতিক সংগ্রামের কথা ব্যক্ত করেন। রঙটি কেবল একটি চিত্রের অংশ নয়, বরং পুরো উপন্যাসের কেন্দ্রীয় থিমেরও প্রতীক।

এই সংকটের মাঝেই একজন চিত্রশিল্পীর খুন হওয়া পুরো গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। খুনী কে তা জানতে হলে পাঠককে অপেক্ষা করতে হয় উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত। এর মধ্যে উঠে আসে সুলতানের দরবারের রাজনীতি, শিল্পকলার ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রাম, এবং মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এছাড়া বইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রেম। একজন প্রাক্তন প্রেমিক, যিনি বারো বছর পর ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন, তার জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা, তার প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়ার লড়াই এবং তার বাবা হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা পুরো গল্পে একটি আবেগময় প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

উপন্যাসের শৈল্পিক উপস্থাপনায় শুধু রহস্য বা প্রেম নয়, বরং সম্পর্ক, ঈর্ষা, ধর্মীয় মতবাদ এবং সাংস্কৃতিক সংঘাত অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে চিত্রিত হয়েছে। প্রতিটি চরিত্র তাদের নিজস্ব চিন্তা ও আবেগের মাধ্যমে একটি বৃহৎ গল্পের অংশ হয়ে ওঠে। উপন্যাসটি কেবল পাঠকের কাছে একটি চমৎকার গল্প নয়, বরং তাদের ভাবনার গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়।

‘মাই নেম ইজ রেড’ এর শৈল্পিক বর্ণনা এবং কাহিনির জটিলতায় পাঠককে পুরোপুরি মুগ্ধ করে। উপন্যাসটি রহস্য এবং ইতিহাসের মিশেলে একটি অমর সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিশ্বজুড়ে সাহিত্যপ্রেমীদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বড় পত্রিকায় এই উপন্যাস প্রশংসিত হয়েছে। সত্যিই এটি একটি কালজয়ী উপন্যাস, যা সাহিত্যের গভীরতা এবং সৌন্দর্যকে নতুনভাবে চিনিয়ে দেয়।

শিক্ষার্থী,

স্থাপত্য বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি।

এই সম্পর্কিত আরও আর্টিকেল দেখুন

একটি উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বাধিক পঠিত