Saturday, January 25, 2025
হোমসম্পাদকীয়প্রচ্ছদ রচনামার্কিন মুলুকের বৃষ্টিতে 'আপা'র ছাতা ধরা ও কিছু কথা 

মার্কিন মুলুকের বৃষ্টিতে ‘আপা’র ছাতা ধরা ও কিছু কথা 

জোবায়ের সিদ্দিকী 

সম্পাদক, দ্যা ক্যাম্পাস মিরর। 

২০১৬ সালে প্রথমবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন। তখন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছিলেন যে, মার্কিন ভোটাররা হয়তো ভুল করে ফেলেছে। এবার, ২০২৪ সালে সেই ভুলের অজুহাতের সুযোগ নেই। মার্কিন জনগণ জানত যে ট্রাম্প একজন দোষী সাব্যস্ত অপরাধী, যিনি কথায় কথায় মিথ্যা বলেন, এবং যার বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, চার বছর আগে, তিনি ক্ষমতায় থাকা একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করেছিলেন, যা ক্যাপিটলে হামলার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই পরাজয় এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে মনে হয়েছিল তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে।

অন্যদিকে, কমলা হ্যারিসের মধ্যে আমেরিকা প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখেছিল। তবে তারপরও ভোটের ফলাফল বিস্ময়করভাবে ট্রাম্পের পক্ষে এসেছে। চার বছরের মধ্যে কীভাবে তিনি হোয়াইট হাউসে ফিরলেন, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন। ভোটারদের মনস্তত্ত্ব, তার কৌশলী প্রচারণা, এবং বিরোধী শিবিরের দুর্বলতা হয়তো এই “ম্যাজিক” ফলাফলের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন প্রভাব ফেলতে চলেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, আর এর প্রভাব যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও পড়েছে। নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়লাভকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই ট্রাম্পের জয়কে স্বাগত জানিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে, কারণ এটি তাদের মতে দলটির বাংলাদেশের ক্ষমতায় ফিরে আসার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগের শাসনামল, একটি জটিল আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক পটভূমির সঙ্গে জড়িত ছিল। উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্য এবং হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যের মাধ্যমে, বেশ কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক ধারণা করেছিলেন যে, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি সমন্বিত কৌশল ছিল, যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে এক ধরনের ইন্দো-মার্কিন ব্লুপ্রিন্ট কাজ করছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা, মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার চেয়ে, তাদের জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানো ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই, পশ্চিমা দেশগুলো একাধিক নির্বাচন বা রাজনৈতিক সংকটের পরেও বাংলাদেশে স্বৈরশাসক শাসনকে সমর্থন দিতে ছিল প্রস্তুত। তারা বারবার নির্বাচনী পুনর্নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের দাবি জানালেও, মূলত ভারতকে নিজেদের অবস্থান সমর্থক রাখতে, কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

২০১৪ সালে, ক্ষমতায় আসার পর, আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর দমনপীড়ন শুরু করে, বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলন, গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে। পুলিশের, র‌্যাব এবং বিজিবির মতো বাহিনীগুলোকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়, যা রাজনৈতিক সহিংসতা এবং গুম-খুনের ঘটনায় অবলম্বন হয়ে ওঠে। তবে, অবশেষে ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, বিশেষত “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন”, এক নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করে, যা দেশের জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এক অভূতপূর্ব বিপ্লবের সূচনা করে।

এ ধরণের পরিস্থিতিতে, ছাত্র-জনতা একসঙ্গে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পথে অগ্রসর হয়ে অবশেষে দেশের স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। তারা এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নক্সাসকে ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করেছিল।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশাল জয় নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনার ঝড় বইছে। মার্কিন বিদেশনীতি কীভাবে গড়ে উঠবে, বিশেষ করে নতুন প্রশাসনের বিশ্বমঞ্চে কেমন অবস্থান হবে—এ নিয়েই আগ্রহ সর্বাধিক। ২০২৪ সালের এই নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশে বিশেষভাবে আলোচিত, কারণ মাত্র তিন মাস আগেই, ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে এবং ড. ইউনুসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়।

ড. ইউনুসের সরকারের প্রতি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কৌশল কী হবে, তা নিয়ে এখন রাজনৈতিক মহলে বিশ্লেষণ চলছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং সমর্থকরা প্রকাশ্যেই ট্রাম্পের জয় কামনা করেছিলেন, কারণ তাদের মতে, তার বিজয় আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে সহায়ক হতে পারে। ট্রাম্পের বিজয়ে আওয়ামী লীগ আশার সঞ্চার পেলেও, নতুন সরকারের প্রতি তার প্রশাসনের অবস্থান কী হবে তা সময়ই বলে দেবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ট্রাম্পের এই জয়ের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছেন এবং দোয়া করছেন। এমনকি শোনা যাচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে গিয়ে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নাকি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ট্রাম্পের জন্য দোয়া করেছেন। ফেসবুকে এই বিষয়টি ঘিরে পোস্টার ও নানা মন্তব্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

মার্কিন নির্বাচনের পর বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে যে আলোচনা চলছে, তা মূলত অপ্রাসঙ্গিক। মার্কিন রাজনীতিতে পরিবর্তন আসলেও, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পরিস্থিতিতে তার তেমন প্রভাব পড়ে না; দেশের শাসনব্যবস্থা ও অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো অপরিবর্তিতই থেকে যায়। পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা আমাদের ছিল, তা জুলাইয়ের আন্দোলনে তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। সবস্তরের মানুষ উন্নয়ন ও সুশাসনের প্রত্যাশায় ছিল। তবে সাম্প্রতিক কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা সেই আশাকে ম্লান করে দিয়েছে। সুতরাং, মার্কিন প্রেক্ষাপটে কোনো পরিবর্তন এলেও দেশের ভেতরে নতুন কোনো আন্দোলন গড়ে উঠলে হয়তো আগের মতো সমর্থন পাওয়া সম্ভব হবে না।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ায় তার সমর্থকরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে, যদিও নির্বাচনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের সঙ্গে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। নির্বাচনে আগাম ভোটের পরিসংখ্যানে ডেমোক্র্যাটরা কিছুটা এগিয়ে থাকলেও ট্রাম্পের শেষ মুহূর্তের জয়ের মাধ্যমে ভোটারদের সমর্থন তিনি নিজের পক্ষে টানতে সক্ষম হয়েছেন।

এদিকে, গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে ট্রাইবুনাল। দেশে ফিরলে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। গণহত্যার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে কয়েকশত মামলা ইতোমধ্যেই দায়ের হয়েছে। ট্রাম্পের জয়কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের কিছু সমর্থক আশাবাদী হলেও দেশের পরিস্থিতি শেখ হাসিনার জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।

বাস্তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনবে না। কারণ, বাংলাদেশ বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে না। যুক্তরাষ্ট্র আর আগের মতো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানকে অন্ধভাবে সমর্থন করবে না। ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠতা বাড়ালেও ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদের শেষ দিকে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পথ তৈরি করেন। পরে, ২০২১ সালের আগস্টে জো বাইডেনের সময়কালে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারতের গুরুত্ব আগের তুলনায় কমে আসে।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আরেকটি প্রধান স্তম্ভ ছিল চীনবিরোধী অবস্থান, কিন্তু সাম্প্রতিক ব্রিকস সম্মেলনে (২২-২৪ অক্টোবর, ২০২৪) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজেদের পুরোনো বিরোধ ভুলে ব্যবসায়িক সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সহজলভ্য চীনা ঋণ ভারতকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আকৃষ্ট করছে, এবং এর ফলে ভারত এখন চীনের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ভারতের দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনবিরোধী অবস্থান ধরে রাখার চেয়ে চীনের ঘনিষ্ঠতা লাভজনক হবে।

এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের পুরোনো কৌশল ভারতের জন্য ততটা কার্যকর বা প্রয়োজনীয় নয়। ফলে, বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত আগের মতো ঐক্যবদ্ধ থাকবে না, এবং ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তারে ভারতীয় সহায়তার উপর নির্ভর করবে না। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের আশা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।ভারত বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার সম্পর্ককে নতুনভাবে মূল্যায়ন করছে, এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সাম্প্রতিক বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন জয়লাভের দ্বারপ্রান্তে, জয়শঙ্কর তখন ক্যানবেরায় ভারত-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ত্রিদেশীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে বলেন, “যিনিই প্রেসিডেন্ট হন না কেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন একক পথে চলার চেষ্টা করছে, যা তাকে বিশ্ব থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। অতীতে যে মার্কিন প্রাধান্য ছিল, তা আর আগের মতো চলবে না।” জয়শঙ্করের এই মন্তব্যে প্রতিফলিত হয় যে ভারত একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের জন্য প্রস্তুত করছে, যেখানে মার্কিন প্রভাব পূর্বের তুলনায় কমে আসতে পারে।

ভারত বর্তমানে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ব্রিকস জোটের মাধ্যমে এই নয়া বিশ্বব্যবস্থায় প্রবেশ করতে চাইছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে শক্তি ও বাণিজ্যে সুবিধা নিচ্ছে, আর একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখছে। তবে ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ভারতকে তার এই দ্বিমুখী কৌশল পরিত্যাগের চাপ দিতে পারেন, বিশেষ করে যদি তিনি চীন ও রাশিয়া-বিরোধী অবস্থানকে আরও কঠোর করেন। এটি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে মনোমালিন্যের জন্ম দিতে পারে, কারণ ভারত তার স্বার্থ রক্ষায় স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বনে অগ্রসর হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সামনে চ্যালেঞ্জ হবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মধ্যে থেকেও চীন ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ধরে রাখা। ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নতুন ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে পারে, যেখানে ভারত হয়তো তার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনের পর তার সম্ভাব্য পররাষ্ট্রনীতি বুঝতে হলে প্রথমে তার আগের মেয়াদের (২০১৬-২০২০) পদক্ষেপগুলোর দিকে ফিরে তাকানো জরুরি। ট্রাম্পের নীতির মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সংঘাত থেকে দূরে রাখা এবং সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে এনে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। আব্রাহাম অ্যাকোর্ডের মাধ্যমে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত হ্রাস করতে উদ্যোগ নেন এবং আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পরিকল্পনাও তিনিই চূড়ান্ত করেন। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তার কৌশল ছিল দ্বিরাষ্ট্রিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং যেকোনো ধরনের জোটবদ্ধ সামরিক উদ্যোগ এড়িয়ে চলা।

ট্রাম্প তার জাতীয়তাবাদী ধারণা থেকে “মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন” নীতি অনুসরণ করেন, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে মজবুত করতে চান, চীনের বাণিজ্যিক উত্থানকে প্রতিহত করতে চান, এবং অন্য দেশের জন্য যুদ্ধের বোঝা নিতে নারাজ। চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবিলা করার বিষয়টি ট্রাম্পের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের নীতি ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও ইরানের প্রতি কঠোরতা বজায় রাখা, তবে অন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতি মনোযোগ দেওয়া। সম্ভবত এবারও, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবেন, তবে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করবেন। এ প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশও ট্রাম্প প্রশাসনের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে, এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়া ও এরশাদের আমলের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।

ড. ইউনূসের মতো একজন ব্যক্তিত্ব সরকার পরিচালনায় আসুক—এমন আকাঙ্ক্ষা আমার মতো অনেকেরই ছিল। তবে বাস্তবতা বলছে, এমন একটি সরকার গঠিত হলেও তার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা সহজ হবে না। অতীতের সরকারগুলো লাগামহীন ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, এবং জনগণের অধিকার দমনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থাকে যে স্থানে নিয়ে গেছে, তারই প্রতিফলন আমরা ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে দেখেছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে এখনো একই ধরনের প্রতিহিংসার রাজনীতি চলছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আজকের এই পরিস্থিতি দুঃখজনক। অন্তর্বর্তী সরকার সর্বদলীয় অংশগ্রহণে গঠিত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এখানে বিদ্বেষের পথই বেছে নেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধারণা ছিল যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যা জো বাইডেন বা কমলা হ্যারিসের সাথে এতটা দৃঢ় নয়। তাদের বিশ্বাস, মোদির অনুরোধে ট্রাম্প বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী হতে পারেন, যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এমন এক অদ্ভুত সমীকরণের ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী ট্রাম্পের জয় কামনা করছিলেন।

অবশেষে, ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী শিবিরে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানানো হয়, এবং তার বিজয়কে রাজনৈতিকভাবে নিজেদের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি আদৌ তাদের প্রত্যাশার সাথে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ হয়।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে নতুন সরকারের অধীনে দেশের পুলিশ বাহিনীকে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বিত কাজের উদ্যোগ, দেশের মানুষের জন্য একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার, দেশের ৯৫% মানুষের সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং এটি একটি বিপ্লবী পরিবর্তনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে। এই সরকারের একান্ত লক্ষ্য হল দেশের জনগণের স্বার্থে কাজ করা এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন ঘটেছে, তার অব্যাহত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।

তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা এবং বিভক্তির বিষয়টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ষড়যন্ত্রকারীরা সুবিধা নিতে পারে এবং দেশকে পুনরায় অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে রাজনৈতিক বিভাজন দেশকে বিপথগামী করতে পারে, বিশেষ করে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে ভারত বা বিদেশি শক্তির হাতে দেশের ভাগ্য ছেড়ে দেওয়া হলে তা জাতির স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

তবে, দেশের মুক্তিকামী জনগণ একত্রিত থাকলে, তারা যেকোনো ষড়যন্ত্র ও বিভেদকে পরাস্ত করতে সক্ষম হবে। তারা স্বাধীনতার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে এবং তারা জানে, বিভাজন সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করলে অন্য কোনো শক্তি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা, এই সময়ে ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যত নিশ্চিত করার প্রতিজ্ঞা করেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
এই সম্পর্কিত আরও আর্টিকেল দেখুন

একটি উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বাধিক পঠিত