সাদী মোহাম্মদ সাদ, সহকারি সম্পাদক।
পতিত স্বৈরাচারের ঢেলে সাজানো প্রশাসনের কর্তারা আওয়ামী মন্ত্রীদের দুর্নীতির নানা দলিলপত্র গোপন করে ফেলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাষ্ট্র চালানোর নানা ইস্যুতে সাম্প্রদায়ক দাঙ্গা- দ্বন্দ্ব সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রেখে অস্থিরতা তৈরির ষড়যন্ত্র হচ্ছে। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্র্তী সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য সমন্বিত ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে দেশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস পোশাক খাতে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে। নিত্যপণ্যের সরবরাহ লাইনে বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশাসন যাতে সঠিকভাবে কাজ করতে না পারে, তার জন্য পতিত স্বৈরাচারের অনুগতদের মাঠ প্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় বসানোর আয়োজন করা হচ্ছে।
ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, “বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রায় দুই মাস সময় পূর্ণ করেছে। এই সরকারের কাছে জনগণের আশা আকাঙ্খা অনেক। তবে এখনো মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা কাজ করছে। কারণ সংস্কার কর্মকাণ্ডে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।” তিনি বলেন, “কোনো অবস্থাতেই দেশের মানুষকে নিরাশ করা যাবে না। আমাদের সবাইকে সরকারকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করতে হবে।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল টাকার বিনিময়ে জঘন্যভাবে শহীদদের কোরবানির পশুর হাটের মতো কেনাবেচা করছে। কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘সেসব রাজনীতিবিদকে আমরা ধিক্কার জানাচ্ছি। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার নামে যাঁরা রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য ঘৃণ্য-জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছেন, আপনাদের চাপিয়ে দেওয়া এই জঘন্য কৃষ্টি-কালচার অতি সত্বর পরিত্যাগ না করলে তরুণসমাজ আপনাদের ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলবে। সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান, এখনো সময় আছে, জনগণ, তরুণ ও শিক্ষার্থীদের পালস (মন) বোঝার চেষ্টা করুন।’
এ সময় সরকারের সমালোচনাও করে নাসীরুদ্দীন বলেন, ফেনী, কুমিল্লাসহ কয়েক জেলায় বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর ছিল। দুই মাস পেরিয়ে গেলেও শহীদদের পরিবারের পুনর্বাসনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। আহত ব্যক্তিদের অনেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোতে ঘুরছেন, অনেকে অন্ধ ও পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে তিনি শ্রমিক অঙ্গন ও পাহাড়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান।
নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত গণহত্যার বিচার শুরু হয়নি। সরকারের কাছে আহ্বান, যারা গণহত্যা করেছে, গুলি করেছে, যারা হুকুম দিয়েছে, আদালতে বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যেকের যেন শাস্তি নিশ্চিত করা হয়৷ সরকারের ভারতনীতি প্রসঙ্গে আখতার হোসেন বলেন, বর্তমান সরকার কোনোভাবেই ভারতের সঙ্গে নতজানু নীতিতে থাকতে পারে না। এই সরকারকে ভারতের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস রাখতে হবে৷
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে মনে হয়, তাদের অনেকেই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি দুর্বল। অথচ ঐ আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকার গণআন্দোলনের সময় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বিশেষত গত ১৫ বছরে গণতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন ও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন, বিচার ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতি ধ্বংস করেছে। সর্বস্তরে আত্মীকরণ ও দলীয়করণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুন, জনগণের ওপর নির্যাতন-জুলুম, মেগা প্রকল্পের আড়ালে ব্যাপক দুর্নীতি, বিশাল ঋণ নিয়ে লুটপাট এবং বিদেশে লক্ষ কোটি টাকা পাচার এসব নজিরবিহীন অপরাধ সংঘটিত করেছে।
সচেতন মহল প্রশ্ন করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে, গণশত্রু আওামীলীগের নিবন্ধন বাতিল করার জন্য আরও কত মানুষ শহীদ হওয়ার প্রয়োজন ছিল? প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তাতে এ যাবৎ সর্বমোট ১৫৮১ জন শহীদ হয়েছে। সরকারের উচিত, কত জন ছাত্র-ছাত্রী, কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শহীদ হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দলের কত জন শহীদ হয়েছে এবং সাধারণ মানুষ কত জন শহীদ হয়েছে- তা জনসম্মুখে তুলে ধরা উচিত। এছাড়া অনুরূপভাবে আহতদের তালিকাও প্রস্তুত করা প্রয়োজন। এতে জনগণ একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাবে। পতিত স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা গণতন্ত্র হত্যা, মানবাধিকার লংঘন এবং দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য দায়ী, তাদেরকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয় নাই। যেমন ড. মশিউর রহমান, কবির বিন আনোয়ার এবং তথাকথিত মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিক, এদেরকে গ্রেপ্তার না হওয়ার কারণ কেউ জানেনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ইউনিফর্ম পরা কয়েকশ ব্যক্তি দৌড়ে ভারতের বিশেষ বিমানের মাধ্যমে পালিয়ে যায়। এরা কারা, তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।
দেশে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৮-১০ জন বড় ক্রিমিনাল রয়েছে। যারা একনায়কত্ব কায়েম করার জন্য শেখ হাসিনাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে। এই ক্রিমিনালগুলো দেশের ব্যবসাবাণিজ্য এবং অর্থনীতি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেছে, বড় বড় প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করেছে। এদের মধ্যে অনেকে অনৈতিক কাজেও লিপ্ত ছিল। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশের অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছে। রাজনীতিবিদরা তাদের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছে। অন্যদিকে তাদের চুরির টাকাও বিদেশে পাচার করে ব্যাংকগুলোকে ঋণগ্রস্ত করেছে।
এত কিছুর পরও প্রফেসর ইউনূসের সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিস্ময়কর সমর্থনের কারণে কোনো ষড়যন্ত্রই খুব বেশি অগ্রসর হতে পারছে না। প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন উপলক্ষে তার সংক্ষিপ্ত যুক্তরাষ্ট্র সফরে ৫৭টি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রতিটি অনুষ্ঠানে তাকে বিপুলভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটে সহায়তার জন্য উদারভাবে এগিয়ে এসেছে।
এ সময় বাংলাদেশে সংস্কার বিষয়ে জাতিসংঘ সব ধরনের সহায়তার অঙ্গীকার করেছে। বলা হয়েছে, নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য ঢাকার পাশে থাকবে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস নিউইয়র্কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা করেন। সেই আলোচনার সময় বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার প্রশংসা করেন তিনি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকার কথা তিনি উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে সব ধরনের সহায়তাদানের প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
এ সময়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলিসহ অনেক বিশ্বনেতার সাথে সাইডলাইনে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছেন। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সব ধরনের সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, এসব তৎপরতার মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো না গেলে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ভারতীয় লবিকে ব্যবহার করে ঢাকার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হবে। এর মধ্যে অন্তর্বর্তী প্রশাসনে যাতে ভারতপন্থীরা বহাল থাকে, তার জন্য একটি নেটওয়ার্ক তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে জনপ্রশাসনে সচিব ও যুগ্ম সচিব এপিডিসহ কর্মকর্তাদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। তারা প্রধান উপদেষ্টার জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার ও তার একান্ত সচিব আওয়ামী লীগ অনুগত কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিকে দিয়ে আগের সরকারের সব সচিবকে স্বপদে বহাল রাখার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য এসেছে বলে জানা গেছে।
সাবেক সরকারের অনুগত প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সরকারের ভেতরে থেকে সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য সন্তর্পণে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। তারা মনে করছে, প্রফেসর ইউনূসের সরকারকে ব্যর্থ করা গেলে এরপর যে সরকারই আসুক না কেন, স্বৈরাচারের গণহত্যা ও অন্যান্য লুটপাটের বিচার থেকে তারা রেহাই পাবে। স্বৈরাচারের মন্ত্রী ও প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের পালিয়ে যেতেও তারা সহায়তা করেছে বলে জানা গেছে।
মূলকথা হচ্ছে, সংস্কারটা খুব জরুরি দরকার। কারণ এ দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, সুশাসন, বৈষম্যহীন সমাজ, সমৃদ্ধি, শান্তি-শৃঙ্খলা আর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বারবারই আমরা দেখেছি মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। স্বেচ্ছাচারিতা, ঘুষ-দুর্নীতি, লুণ্ঠন, অর্থপাচার, আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি, পেশিশক্তির ব্যবহার, অবৈধ কর্মকাণ্ড, বৈষম্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন থেমে থাকেনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। মানুষ ভেবেছে, নতুন সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কার করবে। উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভিত রচনা করবে। একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে। অর্থনীতিতে আস্থা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেবে। বৈষম্যহীন সমাজ গড়বে। দারিদ্র্য নির্মূল করবে। জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে।
অতীত অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো রাজনৈতিক সরকারই জনগণের প্রত্যাশিত উদার অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র; বৈষম্যহীন সমাজ; বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়নি। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারকেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সংস্কার সম্পন্ন করার দায়িত্ব নিতে হবে।
আমাদের প্রত্যাশা যথাসময়ে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে।