লেখক- সাদী মোহাম্মদ সাদ
বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ একটি স্মরণীয় দিন। ৭ নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। এই বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে ফিরে আসে প্রকাশ্য রাজনীতি, গঠিত হয় রাজনৈতিক দল, পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চক্রান্তমুক্ত হয়ে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিপ্লবের ধারায় ভারতীয় স্বার্থের পরিপূরক অবস্থান থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়। এদিন সিপাহী ও জনতা এক হয়ে বিদ্রোহের মাধ্যমে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করে, যা “জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস” নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক সংকটকালে এই বিদ্রোহের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেশের স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্যের ভিত মজবুত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নামের যে জাতিরাষ্ট্র বা নেশন স্টেটটি জন্ম নিয়েছিল সেই রাষ্ট্রের নাগরিকরা রাষ্ট্রভিত্তিক, আধুনিক ও বাস্তবসম্মত এক জাতীয় পরিচয় অর্জন করে। আত্মপরিচয় লাভের মাধ্যমে নবউদ্দীপ্ত ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে নবোত্থিত এই বাংলাদেশী জাতিসত্তার অভিষেকের দিন ৭ নভেম্বর। আর সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবের মহান শিক্ষা ও তাৎপর্যকে আত্মস্থ করে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, স্বকীয়তা, মর্যাদা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও গৌরব নিয়ে সামনের দিকে এই জাতিসত্তাকে এগিয়ে চলার প্রশস্ত নতুন মহাসড়ক গড়ে দিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান।
এই ঘটনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে গভীর ছাপ ফেলে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সুবহে সাদেকের সময় রাজপথে সূচিত সৈনিক-জনতার সংহতির মধ্য দিয়ে যে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল তাতে পরাস্ত হয়েছিলো একদল কুচক্রী। সেদিন শুধু নয়, ওই ঘটনার পর অনেক দিন পর্যন্ত তাদেরকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাবার সাহস এ দেশের কোনো রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর ছিলো না। সময়ের বিবর্তনে অনেক পরে এসে বিশেষ গোষ্ঠীটি ৭ নভেম্বরের ইতিহাস বিকৃতভাবে প্রচার শুরু করে। আরো পরে শুরু হয় সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার।
এই চক্রটি সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবসকে ‘সৈনিক হত্যা দিবস’ নামে অভিহিত করতে থাকে। জাসদের এককালীন সশস্ত্র শাখা গণবাহিণীর নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল আবু তাহেরকে ৭ নভেম্বরের হিরো এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রিত করাই ওই প্রচারণার আসল উদ্দেশ্য। এ ধরণের বিভ্রান্তি, মিথ্যা প্রচার ও ইতিহাস বিকৃতি যখন চলছে এবং সিপাহী জনতার বিপ্লবে পরাজিত শক্তির সমর্থকরা আজ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে ৭ নভেম্বরের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করতে চাইছে, সেই মুহূর্তে এই দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করা এবং বিপ্লব-সংহতির শিক্ষা ও চেতনাকে আরো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রেক্ষাপট: স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা
৭ নভেম্বরের বিপ্লব ও সংহতির স্বরূপ ও অনিবার্যতা বুঝতে হলে এর সংক্ষিপ্ত পটভূমি জানা দরকার। এ জন্য আমাদের ফিরে তাকাতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রাম এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে সংঘটিত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই নতুন দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক সমস্যাবলী এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা চললেও নানা প্রতিকূলতার কারণে চ্যালেঞ্জগুলো দিনে দিনে আরও গভীর হয়। রুশ-ভারতঘেঁষা বলে পরিচিত তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে তিনি সরকারপদ্ধতি বদল করে নিজেই প্রধানমন্ত্রী হন। কিছুদিনের মধ্যেই তাজউদ্দিনকে তিনি মন্ত্রিসভা থেকেও ড্রপ করে দিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমাদ ও অন্যান্য মার্কিনপন্থীদের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের জন্যও তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেন এবং সফল হন।চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে তিনি গোপনে লবিয়িং শুরু করেন। পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যদের বিচারের দাবিও তিনি ত্যাগ করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের জন্য ঘোষণা করেন সাধারণ ক্ষমা। এগুলো সবই ছিলো পাকিস্তান ও মার্কিন প্রশাসনকে দেয়া তার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ। কিন্তু বেশি দূর এগুনো সম্ভব ছিলো না তার পক্ষে। কেননা সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ তখন রুশ-ভারত প্রভাব বলয়ে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে বাঁধা। ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং অবস্থানগুলো তখন ভারতপন্থীদের কব্জায়। ফলে শেখ মুজিবকেই তাদের কাছে আত্মসমর্পিত হতে হলো। ওয়াদা ভাঙলেন শেখ মুজিব। ভোল পাল্টালেন। নিজের আজন্মলালিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সাজলেন সমাজতন্ত্রী।
১৯৭৫ সালের আগে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, এবং আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সমস্যার সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু চার মূলনীতির ভিত্তিতে দেশ চালানোর জন্য একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বাকশাল গঠন করেন। এই সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং জনগণের একটি অংশের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫: শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড
সশস্ত্র বাহিনীর সমান্তরাল বাহিনী হিসেবে প্রভূত ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গঠন করা হয়েছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনী। এ কারণে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের উপেক্ষিত ভাবতে শুরু করেছিলেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং অভ্যন্তরীণ কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনায়ও সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তারা যখন দেখলেন যে, সরকার পরিবর্তনের শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করার সব আয়োজন শেখ সাহেব সম্পন্ন করেছেন, তখন তারা ক্রুব্ধ হয়ে ওঠেন। সেনাবাহিনীর এই উত্তেজিত অংশটিকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের মার্কিনপন্থী অংশটি এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। দেশের অভ্যন্তরে থাকা কিছু সেনা সদস্য এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল, এবং তাদের নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয় এবং দেশে এক অভূতপূর্ব সংকট তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর খোন্দকার মোশতাক আহমেদকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়, যিনি পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সাথে সহযোগিতা করেন এবং তাদের শাসনক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দেন।
খোন্দকার মোশতাকের শাসন এবং সামরিক বিভ্রান্তি
খোন্দকার মোশতাক আহমেদের ক্ষমতাগ্রহণের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যায়। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত বাকশালের রুশ-ভারতপন্থী অংশটি এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি। তারা পাল্টা আঘাত হানার প্রস্তুতি নিতে থাকে।
মুজিব বাকশাল করে সব দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। আর সিভিল পলিটিশিয়ান মোশতাকের নেতৃত্বাধীন আধাসামরিক সরকার বাকশালও বাতিল করে। ফলে দেশ থেকে রাজনৈতিক দলতো বটেই, রাজনীতিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই রাজনীতিহীন সময়ে স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল সশস্ত্রবাহিনীকে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়।
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক প্রতিরক্ষা বাহিনীর শৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে। এ ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগে সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার অনুগত কতিপয় অফিসারের সমর্থনে খন্দকার মোশতাককে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে বিদ্রোহ করেন।
৩ নভেম্বর সংঘঠিত ওই বিদ্রোহের হোতারা সেনাবাহিনীপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন। চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে অধস্তন কর্মকর্তা খালেদ সেনাপ্রধান পদ থেকে জিয়াকে অপসারিত করেন এবং নিজেকে নয়া সেনাপ্রধান ঘোষনা করেন। মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি, বরং তাদের পুরস্কৃত করেছিলেন। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা অনুভূত হতে থাকে।
অন্যদিকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও বিভ্রান্তি এবং ভীতি বিরাজ করছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক বাহিনী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীতে নানা গোষ্ঠী এবং আদর্শের অনুসারীরা ভিন্নমত পোষণ করতে শুরু করে। এই সময়ে সেনাবাহিনীতে মেজর জিয়াউর রহমানের মতো নেতার উত্থান ঘটে, যিনি জনপ্রিয়তা এবং আদর্শিকভাবে দৃঢ় ছিলেন।
স্বাধীনতার সত্যিকারের ঘোষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তি বাহিনীর জেড ফোর্সের অধিনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার সততা, দেশ প্রেম, রাষ্ট্রপরিচালনায় সফলতা, আওয়ামী দুর্ণীতিবাজদের আমলে ‘তলা বিহীণ ঝুড়ি’ বানানো দেশটাকে উন্নতির দিকে ধাবিত করাটাই পরজীবি, ভারতীয় দালাল আওয়ামী লীগারদের গাত্র দাহের কারণ।
সিপাহী বিদ্রোহ এবং ৭ নভেম্বর বিপ্লব
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পেছনে খালেদের সক্রিয় সমর্থন থাকা সত্ত্বেও ৩ নভেম্বর তিনি মুজিব ভক্তদের বুঝিয়েছিলেন যে, মোশতাকের সরকার অবৈধ। এই সরকারকে আঘাত করে মুজিব হত্যার বদলা নিতে চান তিনি। তার কথায় মুজিবভক্তরা বলেছিলেন, মোশতাককে অপসারণের পর মুজিবের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুলকে ক্ষমতায় বসাতে হবে। কিন্তু মোশতাককে অপসারণের সঙ্গে যুগপৎভাবে ঘটে যায় রহস্যঘেরা জেলহত্যাকান্ড। একদল সৈন্য জেলে ঢুকে নজরুলসহ বিলুপ্ত বাকশালের চার শীর্ষনেতাকে খুন করে। এই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে খালেদ অজ্ঞতা প্রকাশ করলেও অনেকেই তাকে সন্দেহ করতে থাকে।
দেশের এই অনিশ্চিত এবং অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ সালে সিপাহী-জনতা বিদ্রোহের সূচনা হয়। সেনাবাহিনীর নিচু স্তরের সৈনিকদের মধ্যে তৎকালীন সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রতি অসন্তোষ ছিল, যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ক্ষমতা গ্রহণের পেছনে ছিলেন। এই অসন্তোষের ফলে সিপাহীরা বিদ্রোহ করে এবং কর্নেল তাহেরের প্ররোচনায় তারা একটি বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলে।
খালেদ সবখানে তার নিজের কর্তৃত্বকে সংহত করতে পারেনি। সামরিক শাসন বলবৎ করা সত্ত্বেও ক্ষমতার শীর্ষপদে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও বসতে পারেননি। বঙ্গভবন দখল করতে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টেই তার কর্তৃত্ব আলগা হয়ে যায়। সাধারণ সৈনিক ও অফিসাররা খালেদের রহস্যজনক কার্যকলাপের ব্যাপারে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ, সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীতে রক্তক্ষয় ও সংঘাত এড়াতে জেনারেল ওসমানীর হস্তক্ষেপে একটি মাঝামাঝি পদক্ষেপ নেন খালেদ, কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। রুশ-ভারতপন্থীরা পুনরুত্থানের পথ খুঁজছিল।
খালেদের বিদ্রোহে উল্লসিত হয়ে ওঠে তারা। মুজিব ভক্তরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সমবেত হয়ে সভা করে। সেখান থেকে মুজিবের ফটো নিয়ে মিছিল করে, তারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে নিহত নেতার বাসভবনে গিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। ওই সমাবেশ থেকে খালেদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়। মিছিলে খালেদের মা এবং ভাই (আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী মরহুম রাশেদ মোশাররফ) শরিক হন। এই খবর প্রচারিত হলে সেনাবাহিনীসহ সবখানে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সৈনিক ও অফিসাররা বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপন ও মতবিনিময় করে খালেদের ক্ষমতার স্বপ্নকে গুঁডিয়ে দেয়ার সিন্ধান্ত নেন।
৭ নভেম্বর প্রথম প্রহর থেকে সারা দেশের সেনা ছাউনিগুলোর চেহারা বদলে যায়। সৈনিকেরা অস্ত্রহাতে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বেরিয়ে আসেন রাজপথে। প্রত্যেক ক্যান্টনমেন্ট থেকে একদল করে সশস্ত্র সৈন্যকে পাঠিয়ে দেয়া হয় রাজধানীর দিকে। রাত্রির শেষপর্বে তারা ঢাকায় এসে পৌঁছে। মধ্যরাত্রির পর ঢাকা সেনানিবাসেও শুরু হয়ে যায় সৈনিকদের অভ্যুত্থান। ব্যারাক থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা বেরিয়ে আসেন। বন্দী সেনাপ্রধান জিয়াকে মুক্ত করে কাঁধে তুলে সাধারণ সৈনিকরা বেরিয়ে আসেন রাজপথে। অবস্থা বেগতিক দেখে বঙ্গভবন থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পালাতে গিয়ে ঢাকার রাজপথে সৈনিকদের হাতে ধরা পড়েন খালেদ তার কয়েকজন দোসরসহ। ক্রুদ্ধ সৈনিকেরা তাদেরকে গুলি করে হত্যা করেন।
এর অল্প কিছু আগে খালেদের সমর্থক কর্নেল মালেক, শাফায়াত জামিল, জাফর ইমাম, মেজর হাফিজ প্রমুখ কয়েকজন অফিসার পরিস্থিতি অনুধাবন করে তাকে ছেড়ে নিরাপদে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
“বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, কুচক্রিরা নিপাত যাক, জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ” ধ্বনি দিয়ে সৈনিকেরা ৭ নভেম্বর সুবহে সাদেকের সময়ে রাজপথে নেমে এলে তাদের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানাতে সারা দেশের জনগণ রাজপথে নেমে আসেন। শ্রেণীপেশা নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা দেশরক্ষার সৈনিকদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান তোলেন। সেনাদলগুলিকে বিপুল করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করতে থাকে রাজপথের দু’পাশে অপেক্ষমাণ লাখো মানুষ। জনসমুদ্র থেকে বর্ষিত পুষ্পবৃষ্টিতে ছেয়ে যায় ট্যাংক, সাঁজোয়া যান। কামানের নলে সাধারণ মানুষেরা মালা পরিয়ে দেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য!বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর আর এমন দৃশ্যের অবতারণা কখনো হয়নি।
বিদ্রোহীরা মেজর জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে তাকে নেতৃত্বে আসতে আহ্বান জানায়। জিয়াউর রহমান সেই সময় দেশের স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় সংহতির জন্য নতুন করে নেতৃত্ব প্রদান করেন। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে খোন্দকার মোশতাকের শাসনের অবসান ঘটে এবং মেজর জিয়া দেশের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ক্ষমতায় আসেন।
জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব: জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি
৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি মেজর জিয়াউর রহমানকে দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে এক দৃঢ় নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ’৭১-এ ২৫ মার্চের গণহত্যার সূচনায় আওয়ামীলীগের নেতারা আত্মসমর্পণ ও পালানোর পথ বেছে নিলে নেতৃত্বশূণ্য ও আক্রান্ত জনগণ মারাত্মক অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। সেই ঘোর দুঃসময়ে ইথারে ভেসে এসেছিলো একটি কণ্ঠ : ‘আমি মেজর জিয়া বলছি…।’ চট্টগ্রামের কালুরঘাট রেডিও স্টেশন মারফত স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে জিয়া জাতিকে দিয়েছিলেন বরাভয় আর পথনির্দেশ। শুধু মৌখিক ঘোষণা নয়, শুরু করে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ। একইভাবে ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর প্রত্যুষেও জনগণ আবার বেতার তরঙ্গে শুনলো সেই একই কণ্ঠ : ‘আমি জিয়া বলছি’।
জাতীয় দুর্যোগের কান্ডারী জিয়ার নির্দেশনা কান পেতে শুনলো সবাই। তিনি জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বয়ে পরিচালিত হতে থাকে।
জিয়াউর রহমানের অধীনে দেশে জাতীয় ঐক্যের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, দেশের স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সকল শ্রেণির জনগণকে একত্রিত হওয়া জরুরি। তার প্রচেষ্টায় দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠন করা হয় এবং কৃষি, শিল্প, ও বাণিজ্য খাতে ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা
দেশের জাতীয়তাবাদী ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল” (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপি ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, যা দেশের স্বাধীনতার চেতনাকে ধরে রেখে জনকল্যাণে কাজ করার প্রতিশ্রুতি নেয়।
বিএনপির মাধ্যমে জিয়াউর রহমান দেশের জাতীয়তাবাদী দর্শনকে জনগণের মাঝে জনপ্রিয় করেন এবং এটি পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দল হিসেবে গড়ে ওঠে। বিএনপি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণের অধিকার ও কল্যাণের কথা বলত এবং দেশের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিত।
জিয়াউর রহমানের শাহাদাতঃ নিছক বিদ্রোহ না অন্যকিছু?
জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশ এক নতুন উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে একটি সামরিক বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী সৈন্যদের হাতে তিনি শহীদ হন। তার মৃত্যুতে দেশ হারায় এক দৃঢ়চেতা এবং দেশপ্রেমিক নেতাকে, যিনি দেশের স্বার্থকে সর্বদা অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জিয়া প্রবর্তিত উন্নয়নের রাজনীতির কতিপয় সাফল্য:
- সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান।
- জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
- বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া।
- দেশে কৃষি বিপ্লব, গণশিক্ষা বিপ্লব ও শিল্প উৎপাদনে বিপ্লব।
- সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারি সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন।
- গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান।
- গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন।
- গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করা।
- হাজার হাজার মাইল রাস্তা-ঘাট নির্মাণ।
- ২৭৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ।
- নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ।
- কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি।
- কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তানীর পর্যায়ে উন্নীতকরণ।
- যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ।
- ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্টা করে সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিকরণ।
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন।
- তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।
- জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসনলাভ।
- তিন সদস্যবিশিষ্ট আল-কুদস কমিটিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি।*.দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ‘সার্ক’ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ।
- বেসরকারিখাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ।
- জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানীর দ্বার উন্মোচন।
- শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ।
ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে উঠে দেশের জন্য নিবেদিত প্রান জিয়াউর রাহমানকে আজকাল না জেনে অনেকেই অহেতুক দোষারোপ করে যায়। এই জঘন্য ঘৃনিত মনোবৃত্তি কোথা থেকে এসেছে সেই আসল সত্যটা কেউ আজকাল ইতিহাস পড়ে দেখে না। শুধু শহীদ জিয়া নন, বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী, সেক্টর কমান্ডার জলিল সহ এরকম অনেকেই সেই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ভারতের রোশানলে পড়েন। তাদের দোষ ছিল মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে থাকতে চাওয়া। কিন্তু শফিউল্লাহ, একে খন্দকার বা এই রকমের কিছু কোলাবোরেটর ছিল যারা ভারতের অধীনতা গ্রহণ করায় তারা সর্বদাই দিল্লীর প্রিয় পাত্র।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে তাজউদ্দিন ভারতের সাথে ৭ দফা ২৫বছরের অধীনতামূলক চুক্তি করেছিল। শহীদ জিয়া এগুলোর বেশীর ভাগ অগ্রাহ্য করে মধ্যপ্রাচ্য, চীনের সাথে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে। এটাই ইন্দিরা গান্ধী মেনে নিতে পারেনি। ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে হয় ভারতে ফিরিয়ে নিবে নতুবা আজীবন করদরাজ্য করে রাখবে। কিন্তু জিয়াউর রহমান এতে বাধ সাধেন; ওই নোংরা চাওয়ার মুখে লাত্থি দিয়েছিলেন। এই জন্যই শহীদ জিয়ার নামে কুৎসা রটনা আর কেউ করেনা, করে ভারতের কিছু দালাল।
৭ নভেম্বরের জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস বাংলাদেশে একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা করে। এই দিনটি শুধু সিপাহী-জনতার বিদ্রোহের প্রতীক নয়, বরং এটি জাতীয় ঐক্য এবং সংহতির মর্মার্থকেও প্রতিফলিত করে। মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশের যে উন্নয়ন এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা আজও বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয়।