Thursday, September 12, 2024
হোমপ্রবন্ধচিন্তায় চিন্তায় সময় নষ্ট

চিন্তায় চিন্তায় সময় নষ্ট


আমাদের জীবনের এক অমীমাংসিত বিষয় হচ্ছে সময়। সময় বলতে আমরা অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ বুঝলেও বিজ্ঞান সময়কে একটু অন্যভাবে দেখে। অতীত কেবলই আমাদের স্মৃতি। বাস্তবে আমরা শুধু বর্তমানকেই দেখি আর বর্তমানের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা কোন ঘটনার ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারি। সময় নিয়ে বিজ্ঞানে বিতর্কের শুরু নিউটনীয় পদার্থবিদ্যা বা ক্লাসিকাল পদার্থবিদ্যা থেকে যেখানে সময়কে ধ্রুব ধরা হয়েছিলো। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আইনস্টাইন দেখান যে সময় ধ্রুব রাশি নয়। ‘বিগ ব্যাং’ এর সূচনাই সময়ের সূচনা। তখন থেকেই ঘটনার প্রবাহ মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। তা পৃথিবীর হিসেবে আনুমানিক 13.8 বিলিয়ন বছর পূর্বে। এই সময়ের যেহেতু শুরু আছে তাহলে শেষটাও নিশ্চয়ই থাকার থাকা। যে বিন্দুতে এসে মহাবিশ্বের সকল ঘটনা ঘটে যাবে সেটাই সময়ের Ending Point. একটা সময় মহাবিশ্বের সকল শক্তি ভরে পরিনত হবে। সমস্ত কিছু ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে থাকবে। সমস্ত জায়গায় তাপমাত্রা একই বিন্দুতে চলে আসবে। সমস্ত নক্ষত্র নিভে যাবে। পুরো মহবিশ্বে শক্তি বলতে কিচ্ছু থাকবে না। তখন মহাবিশ্ব অন্ধকারাচ্ছন্ন অসীম ভর ছাড়া আর কিছুই নয়। এই point এ এসে সময় অর্থহীন হয়ে যাবে। আর কোনো ঘটনা ঘটার বাকি নেই। এখানেই সময়ের শেষ।

কেউ কেউ ভাবেন সময় বলে আসলে কিছু নেই। যেমন- সূর্য উঠেও না, অস্তও যায় না। আমরাই সূর্যের চারদিকে ঘুরি। অন্য ভাবে চিন্তা করলে- পৃথিবী সৃষ্টির আগেও সময় ছিল, পৃথিবী ধ্বংসের পরও সময় থাকবে। সময়কে ঘড়ি দিয়ে হিসেব করে কোন ফায়দা নেই। ঘড়ি অথবা ইতিহাস কিছুই সময়কে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবে না। সময় চলতে থাকবে অমীমাংসিত কোন রহস্যে।

এই যে রহস্যজনক এ সময় আমরা অতিবাহিত করছি, সেটা কি আসলেই আমারা কাজে লাগাতে পারছি? সময়কে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করছেন এর উপরই নির্ভর করছে আপনার জীবনের সফলতা/ব্যার্থতা। আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে সময়কে নিজের মতো করে নিতে চাই। আমরা চাই সময় হোক স্ব-ময়। কিন্তু সেটা আমরা করতেইবা পারছি কজন? নিজেকে ঠিক যেখানটাতে রাখতে চেয়েছেন সেখানে কি আদৌ রাখতে পেরেছেন নিজেকে? নিজেকে দেয়া হাজারো প্রতিশ্রুতির কতটুকুই বা রক্ষা হয়েছে!

উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এর একটা বিখ্যাত উক্তি আমরা অনেকেই জানি, যেটি হচ্ছে- আমি নষ্ট করেছি সময়, এখন সময় নষ্ট করছে আমায়।

একটু চিন্তা করলে দেখবেন যে আমাদের জীবনের অনেক সময় আমরা মনের অজান্তেই নষ্ট করে এসেছি, এখনো করছি এবং ভবিষ্যতেও নষ্ট হবে। সময় নষ্ট করার জন্য আমাদের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করে আমাদের মস্তিষ্ক। বিষয়টা এমন না যে আমরা অলসতার কারণে সময় নষ্ট করছি। আমাদের সময় নষ্ট হচ্ছে কারণ আমরা সময় সম্পর্কে অসচেতন। আমাদের অধিকাংশেরই জীবনের পারপাস এবং স্বচ্ছতা নেই। যার ফলে আমাদের সময় বেশি নষ্ট হচ্ছে। এমন নয় যে আপনি কোন এক দিকে তাকিয়ে আপনার দিন পার করে দিচ্ছেন অথবা চোখ বন্ধ করে থেকে দিন কাটাচ্ছেন। চিন্তা করে দেখুন আপনি এমন কিছুই করছেন যা আপনার মস্তিষ্ক কাজ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং আপনিও সেটা সানন্দে করেই যাচ্ছেন।

ধরুন আপনি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে চান। কিন্তু আপনি সারাদিনে আপনার রুম পরিষ্কার করছেন, অথবা এ সপ্তাহে কোন কোন পোশাক পরে ভার্সিটি যাবেন সেটার পরিকল্পনা করছেন, অথবা রান্না শিখছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজগুলো নিঃসন্দেহে ভালো, কিন্তু এই কাজগুলো আপনাকে আদৌতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে কোন প্রকার সহযোগিতা করছে না। কাজগুলো প্রথম প্রথম আপনাকে আত্মতৃপ্তি দিলেও মাস দশেক অথবা বছর ঘুরতেই মনে হবে আপনি আপনার ট্রেক থেকে সরে গিয়েছেন। আপনি অনেকগুলো সময় নষ্ট করে ফেলেছেন এবং আপনাকে আবারও প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।

বিষয়টা কারো কারো ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে যে- আপনি সারাদিন খুবই প্রোডাক্টিভ কাজ করেছেন কিন্তু দিন শেষে আপনার কাছে মনে হচ্ছে আপনি সময় নষ্ট করছেন। কারণ একটাই, আপনি নিজের জন্য যে টার্গেট নির্ধারণ করেছেন আজকের দিনে আপনি সেই টার্গেট ফুলফিল করতে পারেননি।

আমাদের সবার জীবনেই কিছু না কিছু উদ্দেশ্য সেট করা আছে। আমরা কেউ ডাক্তার হতে চাই, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ উদ্যোক্তা ইত্যাদি। এমন নয় যে আমাদের উদ্দেশ্য নেই বলেই সময় নষ্ট হচ্ছে। যেমন ধরুন- আপনি শীতের সকালে বাজার করতে যাবেন। বিছানা থেকে উঠেই ভাবছেন এই শীতের সকালে কি গায়ে দিয়ে বাজারে যাবেন, কি কি কিনবেন, বাজার থেকে আসতে কত সময় লাগবে, এসে কোন কাজগুলো করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আসল বিষয় হচ্ছে আপনাকে বাজারে যেতে হবে এবং আপনি যাবেনও। কিন্তু মাঝখানে বসে বসে যে এই বেহুদা চিন্তা করে সময় নষ্ট করলেন তা কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক কর্তৃক সায় দিয়েছে বলেই করেছেন। এই চিন্তাগুলো আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তবে বাস্তবে এর কোন ভ্যালু আপনার জীবনে যুক্ত হচ্ছে না। সুতরাং এই সময়টুকু আপনি চিন্তা করেই নষ্ট করলেন।

আমাদের সমগ্র শরীরের মধ্যে মস্তিষ্কই হচ্ছে সবচেয়ে সহজ-সরল ও বোকা প্রকৃতির। তাকে আপনি যেভাবে কমান্ড দেন, সেভাবেই সে পরিচালিত হয়। মস্তিষ্কে পজিটিভ বা নেগেটিভ যেরূপ ইনফরমেশনই পাঠানো হয়, মস্তিষ্ক সেরূপ তরঙ্গই সৃষ্টি করে এবং শরীরে তার প্রতিফলন ঘটায়। আমরা যখন মস্তিষ্কে নতুন ইনফরমেশন পাঠাই, তখন মস্তিষ্কের নিউরনের মধ্যে নতুন যোগাযোগের পথ তৈরি হয়।

মূলকথা হচ্ছে- আপনার ভালো চিন্তাই পারে সময়কে স্ব-ময় করতে। এজন্যই বলা হয়- Your thought is your energy and energy is the power। বাংলা প্রবচনেও আছে- যেমন চিন্তা তেমন কর্ম, যেমন কর্ম তেমন ফল। চিন্তাশক্তি দিয়েই মানুষ বড় হয়, সুখী হয়, সফল ও সমৃদ্ধ হয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষ তত বেশি বড়, যার চিন্তার শক্তি যত বেশি। অর্থাৎ চিন্তার প্রখরতা-গভীরতা ও দূরদৃষ্টি যার যত বেশি, তিনি তত বড় মাপের মানুষ এবং তার জীবন তত সমৃদ্ধ। আবার চিন্তার দারিদ্র্যের কারণেই মানুষের জীবনে ঘটে এর উল্টোটা।

প্রতিটি মানুষ কমবেশি ভালো চিন্তা করে, আবার সচেতন বা অবচেতনভাবে খারাপ চিন্তাও করে; যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে খারাপ চিন্তা করার কথা স্বীকার করতে চায় না। Positive চিন্তা মানুষকে Positive দিকে পরিচালিত করে, আর Negative চিন্তা মানুষকে নিয়ে যায় Negative পথে। সংগত কারণেই ভালো কাজের পূর্বশর্ত হলো ভালো ভালো চিন্তা। খারাপ বা Negative চিন্তা থেকে ভালো কাজ আশা করা যায় না। Positive thoughts & ideas beget positive results and negative thoughts beget negative results -এ সূত্র চিরন্তন এবং সব মানুষের ক্ষেত্রেই সমান প্রযোজ্য।

প্রশ্ন হতে পারে চিন্তা তাহলে কোথা থেকে আসে?
চিন্তার উৎস হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কে থাকা তথ্যভান্ডার; যে তথ্য সঞ্চয়নের শুরু মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় মায়ের চিন্তা, শোনা ও বলা থেকে। প্রকৃতপক্ষে জন্মের পর থেকে এ ভান্ডার পরিপূর্ণ হতে থাকে; অনেকটা কম্পিউটারের মতো। কম্পিউটার আমাদেরকে যে আউটপুট দেয়, তা নির্ভর করে কম্পিউটারে আমরা যে ডাটা ইনপুট করেছি, সেই ডাটার ওপর। আমাদের ইনস্টল করা ডাটা ও সফটওয়্যারের বাইরে সে কোনোরূপ আউটপুট দিতে পারে না। তেমনি মস্তিষ্কে ডাটা ইন্সটলেশনের ওপর এবং মস্তিষ্কের গড়ন ও প্রকৃতির ওপর মানুষের চিন্তার ধরন ও গুণ নির্ভর করে। মস্তিষ্কে ভালো তথা Positive ডাটা ইনপুট হলে চিন্তার ধরন ভালো বা Positive হতে থাকবে, আর ডাটা খারাপ বা Negative হলে চিন্তা বা কর্ম নেতিবাচক বা খারাপ হতে থাকবে।

আমরা যা চিন্তা করি, তা-ই পরিণত হয় কর্মে। অনুরূপ কর্ম দীর্ঘমেয়াদে পরিণত হয় অভ্যাসে। অভ্যাসের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয় ব্যক্তিত্বের ধরন। এই ব্যক্তিত্ব বা চরিত্রই আমাদেরকে পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। সে গন্তব্য হতে পারে আগরতলা অথবা উগিরতলা; হতে পারে রাজরানি অথবা চাকরানি। তাই বলাই যায়, মানব জীবনে সফলতা বা ব্যর্থতার একক ও মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে চিন্তা। চিন্তা শক্তির উন্নয়নের মাধ্যমেই মানুষের জীবনে ব্যাপক সাফল্যের দুয়ার উন্মোচিত হয়। তাই আমাদের চিন্তা সঠিক পথে পরিচালিত করা এবং মস্তিষ্কে থাকা অতীতের খারাপ তথ্যের স্থলে ভালো তথ্য ইনপুট করার কলাকৌশল জানা থাকলে যে কেউ সহজেই উন্নততর মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। Positive belief বা Positive thought -এর মাধ্যমে নিজের মধ্যে প্রচুর Energy তৈরি করা এবং সে Energy দিয়ে নিজকে Powerful being তথা শক্তিশালী মানুষরূপে গড়ে তোলা কঠিন কিছু নয়। আমরা নিজেরাও জানি আমরা সঠিক সময়ে সঠিক চিন্তা করছি না।

আমরা ভুলের মধ্যে আছি এবং ভুল করে সময়গুলো নষ্ট করছি। কিন্তু আসল সমস্যা হচ্ছে আমরা এই ভুলগুলোকে অভ্যাসে পরিণত করছি।

মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম রোমান
সাবেক সহকারী সম্পাদক,

দ্যা ক্যাম্পাস মিরর

পরবর্তী নিবন্ধ
এই সম্পর্কিত আরও আর্টিকেল দেখুন

একটি উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বাধিক পঠিত