আজিজুল হক
দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আকারের বাজেট পাস হলো সংসদে, এমন একটি সময় বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী: জাতিকে উপহার দিলেন- যখন মূল্যস্ফীতির চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতন, ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বলতা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে যে অর্থনৈতিক সংকট বিরাজ করছে, এর ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আরও অনেক বেশি ভঙ্গুর হয়ে গেছে। সংবাদপত্রে উঠে আসা রিপোর্ট বলছে, নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের কারণে কষ্টে আছে মানুষ।
মে মাসেও মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি। আছে ডলার-সংকট। এ কারণে পণ্য আমদানি সংকুচিত করে রাখা হয়েছে। গত বছরের মে মাসের তুলনায় এ বছরের মে মাসে রপ্তানি আয় কমে গেছে ১৬ শতাংশ। আবার রাজস্ব আয়েও ভালো প্রবৃদ্ধি নেই। বাড়ছে দেশি-বিদেশি দেনা পরিশোধের চাপ।
কিন্তু এতসবের পরেও, অর্থনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ বোঝেন না শ্রমজীবীসহ সমাজের নিম্নআয়ের মানুষরা। ক্ষুধার তাড়নায় খাদ্য জোগাতে হিমশিম খাওয়া মানুষজন বোঝেন প্রতি বছর বাজেট মানেই ব্যয়ের নতুন নতুন খাত তৈরি হওয়া। তাই বাজেট নিয়ে তাদের উৎসাহ কম, বরং আতঙ্কটাই বেশি।
জাতীয় সংসদে বাজেট বক্তব্যের শুরুর দিকে অনেক প্রতিশ্রুতি থাকে, ভালো ভালো কথা থাকে। কিন্তু শুভংকরের ফাঁকিতে তা আর কাজে লাগানো হয় না। বরং সুবিধাবাদীদের স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন ধরনের বিচিত্র সব করের প্রস্তাব দেয়া হয়। এ ধরনের নৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিহীন দর্শন যে বাজেটে থাকে, তাতে সংবিধানে উল্লেখিত বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
আমরা একটি দীর্ঘকাল ধরে দেশের অর্থনীতির চরকায় যে সুতো কাটতে দেখেছি- মোটাদাগে সেগুলোর নাম যদি আমরা ধরে নেই নীতিমালা: সেগুলো তিন ধরনের-নীতির ভ্রান্তি ও দুর্বলতা, নীতি গ্রহণে দ্বিধা-দ্বৈত নীতি। এসবের সুনিপুণ মেলবন্ধনে হয়েছে নীতির অসারতা- সারমর্ম হিসেবে যা অকার্যকর হয়ে গেছে। গত দুইটা বছর ধরে টানা নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ পতনে রাষ্ট্র নির্বিকার, মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনে নিদারুণ পুরবস্থা চলছে।
কিন্তু এই সংকটে আমরা কী নীতি গ্রহণ করলাম? সংকাটকালীন সময় কোনো উদ্ভাবনী নীতি কাজে আসে না, প্রথাগত নীতি বাস্তবায়ন করতে হয়। মূল্যস্ফীতি কমানোয় মৌলিক নীতি হলো বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমানো ও নির্দিষ্ট খাত অনুসারে সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া। সারা বিশ্ব এ নীতি অনুসরণ করেছে। ভেঙে পড়া শ্রীলঙ্কা আমাদের সামনে ভুলন্ত আমরা তো এ এ পথে অগ্রসর হবো না। আমাদের খুল্লাম যুল্লা সুদহারের নয়-ছয় নীতি প্রণয়ন হয়। কাদের সঙ্গে আলাপ করে এটি করা হয়ে সেটিও আমরা জানি- যা এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু এর ফলে কি বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে? কিংবা বাজি খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে? উত্তর হচ্ছে, না, এমন কিছুই ঘটেনি। একদিকে আমরা বাজারভিত্তিক অর্থনীতির কথা বলছি, অন্যদিকে চরম নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক নীতিমালা বজায় রেখেছি। যার ফলে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি।
পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি প্রায় ৭০ শতাংশে পৌঁছেছিল। শ্রীলংকা কীভাবে খাদ থেকে উত্তরণে সফল হলো? আমাদের দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিই বলে দিচ্ছে আমরা যথাসময়ে সঠিক নীতি গ্রহাণ ব্যর্থ হয়েছি।
অকার্যকর নীতি বাস্তবায়ন করতে চাওয়ার আরেকটি বড় উদাহরণ হলো বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপক রিজার্ভ পতন। আমাদের মোট জাতীয় রিজার্ভ ক্রমেই নিম্নমুখী। এ পরিস্থিতির কোনো দৃশ্যমান উন্নতি নেই। আমরা ডলার বিনিময় হারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ধরে রাখতে চেয়েছি যেন জিডিপিতে মাথাপিছু আয় বেশি দেখানো যায়। আমাদের পলিসিমেকারদের মধ্যে এটি এক ধরনের ধারণাগত ভুল। যেখানে বিশ্বের অন্যতম দোলাচালে থাকা রাষ্ট্রের তালিকায় ভারত, চীন, ভিয়েতনামসহ অন্য দেখ ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান অবমূল্যায়ন করল, সেখানে আমাদের দেশে দীর্ঘ সময় টাকা শক্তিশালী করে রাখা হয়। এরপর হঠাৎ করেই টাকার মানের অবমূল্যায়ন করা হলে সেই চাপ গিয়ে পড়ে আমদানিতে। রিজার্ভ ক্ষয় বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে এ পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে (বাজারভিত্তিক সুদহার ও ক্রলিং গেগ) সেগুলোও সময়মতো গ্রহণ হ্যালি, হলেও অণেক দেরিতে গ্রহণ করা হয়েছে, সেটিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে। অথচ দেশের অর্থনীতিবিদরা এসব সুপারিশ অনেক আগে থেকেই করে আসছেন যা গ্রহণে আমাদের এক ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতা দেখা যায়।
মনে রাখা দরকার মুদ্রানীতি এককভাবে কাজ করে না। আর্থিক নীতির সামঞ্জস্যতা রক্ষা করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সমন্বিত অর্থনৈতিক সূচকের দিক না তাকিয়ে আইএমএফের চাপে তাদের কথাই যোগ-বিয়োগ করে নতুন বাজেট করা হয়েছে এখানেও আইএমএফ কম আকারের বাজেট দিতে বলেছিলো, যা বাস্তবায়ন হয়নি কাগজ কলমেও।
ঘোষিত এই বাজেটে দুটি সমস্যাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া যেত মূল্যস্ফীতি কমানো ও সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয়া। প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন বাজেট ও পরিচালন ব্যয় সমন্বয় করা হয়নি, উন্নয়ন বাজেটও কমানো যেত। কারণ জাতীয় সংকটের সময়ে সাধারণ ঐকিক নিয়মের মধ্যেই কৃচ্ছ্রসাধন হয়।
এই বাজেটের আরেকটি বিতর্কিত ব্যাপার হচ্ছে বড় বড় মেগা প্রকল্প নেয়া। অর্থনীতিবিদ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা যেগুলো নিয়ে ব্যাপক কথাবার্তা বলছেন। এই মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে চারটি এ বছর আর ছয়টি ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা। প্রতি প্রাক্কলিত ব্যায়ের বাইরে বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পগুলোকে চলমান রাখার তো কোনো দরকার নেই। বরং যেগুলো শেষের পথে কেবল সেগুলোর বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন করা যেত। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেট সমন্বয়ের অভাবে আসন্ন অর্থবছরেও বাজেট ঘাটতি রাখা হয়েছে জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। গত বছর এটি ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। তাহলে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা কীভাবে করা হলো? আর মানুষকে স্বস্তি দেয়া যেত সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দের মাধ্যমে। কিন্তু এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর বিষয়টি যদি জিডিপির শেয়ারে বা মোট বাজেটের আকারে দেখিড়সামান্য একটু পরিবর্তন হয়েছে। বাজেটের হিসাবে দেখলে গত বছর যেটা ১৭ শতাংশ, এ বছর সেটা ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। জিডিপির আকারে দেখলে সেক্ষেত্রেও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। এ খাতের বরাদ্দ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে।
বিস্তারিত দেখলে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মচারী ও তাদের পরিবারদের পেনশনের টাকা, সঞ্চয়পত্রের সুদের অর্থ, কৃষি খাতে ভর্তুকি, মুক্তিযোদ্ধাদের যে বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ খাতে। এগুলো করার ফলে এ খাতের বরাদ্দে একটা বড় অ্যামাউন্ট দেখা যায়। কিন্তু সেগুলো যদি বাদ দেয়া যায় তাহলে কিন্তু খুব একটা বাড়েনি, বরং কমেছে। তবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সরকার বেশকিছু পণ্যের ওপর কর ছাড়ের প্রস্তাবও করেছে। এটি একটি ভালো প্রস্তাব। কিন্তু বিষয়টি হচ্ছে কীভাবে তা বাস্তবায়ন হবে। দেখা যায় কর কমানোর পর বাজারে পণ্যের দাম সেই অনুপাতে কমে না, এক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। করের দোহাই দিয়েই মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়, বাজার মনিটরিং করা হয় না।
বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতি বছরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। যদিও রাজস্ব বোর্ডের ওপর দেয়া লক্ষ্যমাত্রা গত ১০ বছরে কোনোভাবেই পরিপালন করা সম্ভব হয়নি। চলতি বছরে যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছিল সেটার তুলনায় আগামী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। অথচ চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ঘাটতি রয়ে গেছে। তাই লক্ষ্যমাত্রাটা বাস্তবসম্মতভাবে করা উচিত। রাজস্ব আহরণের জন্য অনেক প্রচেষ্টা দেখছি। দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন জুসের ওপর, মোবাইল ফোনের টকটাইমের ওপর, পার্কে প্রবেশ ফির ওপরে দেয়া হচ্ছে। এগুলো তো ভোক্তাদের ওপরে গিয়ে পড়ে। বিদ্যমান কাঠামো দিয়ে বেশি রাজস্ব আহরণ সম্ভব নয়। এছাড়া করনীতি ও কর প্রশাসন এখনো আলাদা নয়। আবার অনেকে কর দিতেও চান, ভাবেন সৎভাবে বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু তা নেয়ার সক্ষমতা নেই সরকারের। তাই কর কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন। কর কাঠামোর সঙ্গে প্রযুক্তির সংযোগ ঘটিয়ে এ ব্যবস্থার সরলীকরণ আবশ্যক। আরেকটি সংস্কারের কথা অর্থনীতিবিদরা সর্বদাই বলে আসছেন তা হলো ব্যাংক খাতের সংস্কার। ব্যাংক খাতকে অর্থনীতির ‘প্রাণকেন্দ্র’ বলা হয়। বিভিন্ন খাতকে চলমান রাখার জন্য দরকার ভালো ব্যাংক খাত। অথচ খাতটি ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতর হয়ে গেছে। এ খাতে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু নেই, আস্থাও নেই। কিছু ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করে। ব্যাংক খাত গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করে চলছে। এ খাতে চালু হয়েছে ঋণ পুনঃতফসিল করার সংস্কৃতি এবং নতুন নতুন কায়দায় তা করা হচ্ছে। ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে বারবার পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেয়া হয়েছে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া। এতে মানুষের আস্থার জায়গাটা ভেঙে গেছে। জনপ্রতিনিধিরা কীভাবে তা ফিরিয়ে আনবেন, সেটাও এ বাজেটের একটা লক্ষ্য হওয়া উচিত।
আমরা কেবল প্রবৃদ্ধির কথা বলছি। কিন্তু এ প্রবৃদ্ধি আমাদের কী দিল? আয়বৈষম্য তো বাড়ছেই। পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সক্ষমতা কমে গেছে অর্থনীতির। বলা হচ্ছে, বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এ হিসাব কীভাবে করা হয়, তা তো আমরা জানি। সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ করলেও তা যুক্ত হচ্ছে। বাস্তবে বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। কিছুদিন আগে একটি পত্রিকায় এসেছে, চাকরির জন্য এসএসসি পাস দরকার, অথচ আবেদন বেশি এসেছে মাস্টার্স পাস প্রার্থীদের কাছ থেকে। এর পরও যে চাকরিগুলো সৃষ্টি হচ্ছে সেগুলো অনানুষ্ঠানিক খাতে। যতটুকু প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার বেশির ভাগই অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে আসা। শিল্প খাতে ৯০ শতাংশের বেশি এবং সেবা খাতে ৬৭ শতাংশের বেশি অনানুষ্ঠানিক খাতের অবদান। অথচ অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের আয় কম ও কাজের নিশ্চয়তা নেই। তবু বাজেটে শ্রমবাজার সংস্কারের কোনো লক্ষ্যমাত্রা নেই। আরেকটি সংস্কারের কথা না বললেই নয়ড়প্রশাসনিক সংস্কার। আগেও একবার বলেছি বড় বড় মেগা প্রকল্প সময়মতো শেষ হয় না। অথচ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, ব্যয় হচ্ছে। এ খাতে জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সরকারি সেবা দেব, কিন্তু জবাবদিহির বাইরে থাকব, তা ঠিক নয়। নিজেরা জবাবদিহির বাইরে থাকলে অন্যদের কীভাবে এর মধ্যে আনবেন? ক্ষমতাসীন ও দুর্নীতিবাজদের সুবিধা দেব, অন্যদেরও ছিটেফোঁটা এদিক-সেদিক দেব-এমন অনুমিতি ও দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই বাজেট করা হয়েছে। অন্যরা তা গ্রহণ করলে করুক, চিৎকার করলে করুক, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই সরকারের। এসব পদক্ষেপের নৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই। নৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে অবজ্ঞা করে বৈষম্যমূলক সমাজ সৃষ্টির কাজ করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সৌভাগ্য তথা স্বাধীনতার সুফল সবার মধ্যে সুষম বণ্টন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সুনিশ্চিত সুশাসন এবং জবাবদিহির সুযোগ ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা গড়ে ওঠে না। গণতান্ত্রিক মূলবোধ প্রতিষ্ঠায় অযুত ত্যাগ স্বীকারের প্রকৃত প্রতিফল অর্জন সম্ভব হয় না সুশাসন সুনিশ্চিত না হলে। সম্পদ অর্জনের নৈতিক ভিত্তি বা প্রক্রিয়া স্বচ্ছ না হলে বণ্টন ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু হয় না। সমাজে বণ্টনবৈষম্য দূর করতে সুশাসন প্রেরণা ও প্রভাবক ভূমিকা পালন করে থাকে। এটি দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার জন্যও জরুরি। যেমন- আজকাল এক দেশ বা অর্থনীতির প্রচুর অর্থ বিদেশে কিংবা অন্য অর্থনীতিতে দেদার পাচার হয়ে থাকে। বিনা বিনিয়োগে বা বিনা পরিশ্রমে প্রকৃত পণ্য ও সেবা উৎপাদন ব্যতিরেকে অর্থ অর্জিত হলে অবৈধভাবে অর্জিত সেই অর্থ পাচার হবেই। অর্থ বৈধ পন্থায় উপার্জিত না হলে সে অর্থের মালিকানার প্রতি দায়-দায়িত্ববোধও গড়ে ওঠে না। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি শক্তিশালীকরণেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক পরিবেশের আবশ্যকতা রয়েছে। কেননা, সমাজে একপক্ষ বা কতিপয় ব্যক্তি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্যে থাকলে, আর বেশির ভাগের কারো কাছে কোনো জবাবদিহিতা না থাকলে অর্থাৎ একই যাত্রায় ভিন্ন আচরণে নিষ্ঠ হলে পারস্পরিক অভিযোগের নাট্যশালায় জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে না। সমতা বিধানে, সবার প্রতি সমান আচরণের (যা গণতন্ত্রের মর্মবাণী) জন্যও স্বচ্ছতা তথা আস্থার পরিবেশ প্রয়োজন। আরেকটি বিষয়, সুশাসনের অবর্তমানে জবাবদিহিহীন পরিবেশে, আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতার অবয়বের অন্যতম প্রতিফল হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি শুধু ব্যক্তিবিশেষ অর্থাৎ যে দুর্নীতি করে তাকে ন্যায়নীতিহীনতার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে তা নয়, তার দ্বারা সমাজকে নেতৃত্বদান বা যেকোনো ক্ষেত্রে দৃঢ়চিত্ত অবস্থান গ্রহণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। সর্বত্র তাকে দুর্বল করে দেয়। দুর্নীতিবাজ নেতৃত্বের জন্য বা কারণে সমাজে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়। নেতৃত্বের এ অধোগতির প্রেক্ষাপট প্রত্যক্ষভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবজনিত পরিবেশ নির্মাণ করে। নেতৃত্বের কার্যকলাপে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকলে সমাজে সংসারে সে নেতৃত্বের অধীনে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়। এটি পরস্পর প্রযুক্ত সমস্যা। স্বচ্ছতা-জবাবদিহির অনুপস্থিতির অবসরে আত্মঘাতী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেমন- যেকোনো সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ। যেমন- স্বেচ্ছাচারিতায়, নানান অনিয়ম ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে শিক্ষায়তনে শিক্ষক, সুশীল সেবক, হাসপাতালে চিকিৎসক কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কর্মীবাহিনী নিয়োগ। অর্থ বিনিময় ও নানান অনিয়মের কারণে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে ভালো এবং যোগ্য সুশীল সেবক, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনরক্ষক নিয়োজিত হতে পারে না। সুশীল সেবক, চিকিৎসক অমেধাবী ও অযোগ্য শিক্ষক এবং আইন রক্ষকের কাছ থেকে গুণগত মানসম্পন্ন প্রশাসনিক সেবা, চিকিৎসা, শিক্ষা বা তালিম বা অনুসরণীয় আদর্শ লাভ সম্ভব হয় না। নানা আঙ্গিকে পরীক্ষা-পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী এমনকি চাকরিজীবীদেরও বাঞ্ছিতভাবে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। অতিমাত্রায় কোটারি, সিন্ডিকেট বা দলীয় বা রাজনীতিকীকরণে পেশাজীবী, সংস্থা সংগঠন এবং এমনকি সুশীলসেবকরাও প্রজাতন্ত্রের হয়ে দলনিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে, গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয় যার ছত্রছায়ায় বিভিন্নভাবে অবৈধ অর্জন চলতে এর পথ সুগম হতে পারে। সেবক প্রভুতে পরিণত হলে সম্পদ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহারের দ্বারা অর্জিত অর্থ দখলের লড়াইয়ে অর্থায়িত হয়ে এভাবে একটি ঘূর্ণায়মান দুষ্টচক্রবলয় হয়ে থাকে। অর্থাৎ সুশাসনের অভাবে স্বচ্ছতার অস্বচ্ছতায় ঘুরেফিরে পুরো প্রক্রিয়া বিষিয়ে তোলে। সুতরাং সব ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে উচিত স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এটি প্রয়োজন গণতন্ত্র ও সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুশাসন স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে সত্যিকার উন্নয়ন হবে না। এটি পরস্পরের পরিপূরক। স্বচ্ছতার অস্বচ্ছতায় যে উন্নয়ন হয় তাতে জনগণের সুফল নিশ্চিত হয় না। এ উন্নয়নের কোনো উপযোগিতা বা রিটার্ন নেই। এটি এক ধরনের আত্মঘাতী ভেল্কিবাজি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির মূল কথা হলো- যে অর্থই ব্যয় করা হোক না কেন, সেই আয়-ব্যয় বা ব্যবহারের দ্বারা অবশ্যই পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হতে হবে। পণ্য ও সেবা উৎপাদনের লক্ষ্যে যে অর্থ আয় বা ব্যয় হবে সেটিই বৈধ। আর যে আয়-ব্যয় কোনো পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে না সেটি অবৈধ, অপব্যয়, অপচয়। জিডিপিতে তার থাকে না কোনো ভূমিকা। আরো খোলাসা করে বলা যায়, যে আয় পণ্য ও সেবা উৎপাদনের মাধ্যমে অর্জিত হয় না এবং যে ব্যয়ের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয় না সেই আয়-ব্যয় জিডিপিতে কোনো অবদান রাখে না। কোনো প্রকার শ্রম বা পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়া মওকা যে আয় তা সম্পদ বণ্টন বৈষম্য সৃষ্টিই শুধু করে না সেভাবে অর্জিত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ধার ধারা হয় না। ফলে তা সৃষ্টি করে আর্থিক বিচ্যুতি। এভাবে যে অর্থ আয় বা খরচ করা হয় তা প্রকারান্তরে অর্থনীতিকে পঙ্গু ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে।
-লেখক
কলামিস্ট ও অর্থনীতি বিশ্লেষক