সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেছে ভূরাজনীতি, পরিবর্তিত হয়েছে যুদ্ধের কৌশল। তবে ইতিহাসে কিছু যুদ্ধ এখনো মানুষের কৌতূহল ও বিস্ময়ের বিষয় হয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের “লেইট উপসাগরের যুদ্ধ” বা “ব্যাটল অব লেইট গালফ” তেমনই এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা মানব সভ্যতার বৃহত্তম নৌযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তির দ্বন্দ্বের মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির সঙ্গে থাকলেও ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়। যুদ্ধের শুরুতে অক্ষশক্তি শক্তিশালী অবস্থানে থাকলেও মিত্রশক্তি দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইউরোপে “অপারেশন ওভারলর্ড” জার্মানিকে দুর্বল করে ফেললেও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপান তখনও প্রতিরোধ গড়ে রেখেছিল।
জাপানকে পরাজিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় নৌযুদ্ধের পরিকল্পনা করে, যা যা ১৯৪৪ সালের ২৩ থেকে ২৬ অক্টোবর ফিলিপাইনের লেইট উপসাগরে সংঘটিত হয় এবং ইতিহাসে “ব্যাটল অব লেইট গালফ” নামে স্মরণীয় হয়ে আছে।
এই যুদ্ধে প্রায় দুই লাখ নৌসেনা অংশ নেয় এবং জাপান প্রথমবারের মতো তাদের ভয়ংকর “কামিকাজে” কৌশল প্রয়োগ করে। এই কৌশলে আত্মঘাতী পাইলটরা যুদ্ধবিমান নিয়ে শত্রুপক্ষের জাহাজে আঘাত হানত, যা যুদ্ধের একটি ভয়াবহ দিক হয়ে ওঠে।
এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজ ইউএসএস প্রিন্সটন জাপানি বিমানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি বোমার আঘাতে জাহাজের ভেতরে থাকা টর্পেডোগুলো বিস্ফোরিত হয়, যা যুদ্ধের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই ঘটনার একটি বিখ্যাত ছবি নিউ অরলিন্সের “দ্য ন্যাশনাল ওয়ার্ল্ড ওয়ার মিউজিয়ামে” সংরক্ষিত রয়েছে। লেইট উপসাগরের যুদ্ধ জাপানের জন্য এক বিশাল পরাজয় ছিল, যা কার্যত অক্ষশক্তির পতনের সূচনা করে এবং মিত্রশক্তির বিজয় নিশ্চিত করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় নৌযুদ্ধ এর আগে কখনো হয়নি। এটি শুধুমাত্র কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং যুদ্ধবিদ্যার এক স্থায়ী উদাহরণ হিসেবে রয়ে গেছে।
১৯৩৯ সালে জার্মানি যখন পোল্যান্ড আক্রমণ করে, তখন ফ্রান্স ও ব্রিটেন তীব্র বিরোধিতা করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র তখনও নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল। কিন্তু ১৯৪১ সালে, যখন জাপান অক্ষশক্তির পক্ষে যোগ দিয়ে পার্ল হারবারে আকস্মিক আক্রমণ চালায়, তখন যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হয়ে মিত্রশক্তির সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের ফলে ইউরোপের সংঘর্ষ বৈশ্বিক পরিসরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেয়। যুদ্ধের শুরুতে নাৎসি জার্মানির আক্রমণের মুখে মিত্রশক্তি অসহায় হয়ে পড়ে, এমনকি ফ্রান্সও তাদের দখলে চলে যায়। একই সময়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় জাপান তাদের আধিপত্য বিস্তার করছিল। পার্ল হারবারের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী বড় ধরনের ধাক্কা খায়, এবং প্রশান্ত মহাসাগরে জাপান শক্তিশালী অবস্থানে চলে যায়। তবে মিত্রশক্তি দ্রুত নিজেদের সংগঠিত করে এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
যুদ্ধের প্রথমদিকে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে থাকা মিত্রশক্তি ধীরে ধীরে আক্রমণাত্মক কৌশল গ্রহণ করে। বিশেষ করে ১৯৪৪ সালে ফ্রান্স মুক্ত হওয়ার পর, ইউরোপে নাৎসি বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পশ্চিম ইউরোপে মিত্রশক্তির জয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। একই সময়ে, জাপান তাদের আগ্রাসী নীতি থেকে সরে এসে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়।
এই পরিস্থিতিতে, ইউরোপে যুদ্ধ প্রায় নিষ্পত্তির পথে থাকায় মিত্রশক্তির দৃষ্টি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দিকে ঘুরে যায়। এবার তারা জাপানের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চল পুনরুদ্ধার এবং তাদের শক্ত ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে। মূল লক্ষ্য ছিল এমন স্থান আক্রমণ করা, যা জাপানের সামরিক অবস্থান দুর্বল করবে। তবে এই কৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মহলে মতবিরোধ দেখা দেয়।১৯৪৪ সালের পর মিত্রশক্তি এতটাই শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যায় যে, জাপানের যেকোনো ঘাঁটিতে আক্রমণ করার যথেষ্ট সামর্থ্য তাদের ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের চিফ অফ নেভাল অপারেশন, অ্যাডমিরাল আর্নেস্ট জে. কিং ফরমোজা দ্বীপ (আজকের তাইওয়ান) আক্রমণের পক্ষে মত দেন, কারণ এতে জাপানের জ্বালানি সরবরাহের পথ ব্যাহত হতো। তবে মিত্রশক্তির অভ্যন্তরে এই কৌশল নিয়ে মতবিরোধ থাকায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগে।
যুদ্ধের মঞ্চে একের পর এক অগ্রসর হতে থাকা মিত্রশক্তি ধাপে ধাপে জাপানের প্রতিরক্ষা দুর্বল করে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়।
১৯৪৪ সালে জাপানের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তির মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। অ্যাডমিরাল আর্নেস্ট জে. কিং ও অ্যাডমিরাল চেস্টার নিমিত্জ ফরমোজা দ্বীপে আক্রমণের পক্ষে ছিলেন, যদিও নিমিত্জ একই সঙ্গে ফিলিপাইনেও হামলার পরিকল্পনা করেন। অন্যদিকে, আর্মির চিফ অফ স্টাফ জর্জ কাটলেট মার্শাল সরাসরি জাপানের হোনশু দ্বীপে আক্রমণের প্রস্তাব দেন।তবে জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার দৃঢ়ভাবে ফিলিপাইন আক্রমণের পক্ষে ছিলেন। তার এই সিদ্ধান্ত শুধু কৌশলগতভাবে নয়, ব্যক্তিগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৪২ সালে ফিলিপাইনে জাপানের কাছে পরাজিত হয়ে পিছু হটার সময় তিনি বলেছিলেন, “আমি আবারও ফিরে আসবো।” সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তিনি অটল ছিলেন।
কৌশলগতভাবেও ম্যাকআর্থারের পরিকল্পনা ছিল বাস্তবসম্মত। যদি সরাসরি ফরমোজা আক্রমণ করা হতো, তাহলে জাপান সহজেই ফিলিপাইন থেকে সেনা ও রসদ পাঠিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত। কিন্তু ফিলিপাইন দখল করলে জাপানের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌঘাঁটি ধ্বংস করা সম্ভব হতো, যা পরবর্তীতে ফরমোজায় আক্রমণকে সহজ করে দিত। দীর্ঘ বিতর্কের পর, অবশেষে ম্যাকআর্থারের পরিকল্পনাই গৃহীত হয়, যদিও এটি চূড়ান্ত হতে দুই মাসেরও বেশি সময় লেগেছিল।
এদিকে, জাপান নিশ্চিত ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র শিগগিরই আক্রমণ করবে, কিন্তু ঠিক কোথায় তা অনুমান করতে পারছিল না। তাই তারা সম্ভাব্য প্রতিরক্ষার জন্য চারটি পৃথক পরিকল্পনা তৈরি করে, যা সাংকেতিক নামে পরিচিত ছিল শোগো ১, ২, ৩, এবং ৪।
- শোগো ১: ফিলিপাইনে আক্রমণ হলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
- শোগো ২: ফরমোজার জন্য প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা।
- শোগো ৩ ও ৪: অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটির জন্য সংরক্ষিত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা।
১২ অক্টোবর ১৯৪৪ সালে, অ্যাডমিরাল চেস্টার নিমিত্জ ফরমোজা দ্বীপের দিকে অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নেন। জাপান মনে করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র ফরমোজায় হামলা চালাবে এবং তারা শোগো ২ পরিকল্পনা কার্যকর করে। জাপান তাদের নৌবাহিনীর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিমিত্জের বহর প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেয়। এটি ছিল তাদের পুরনো যুদ্ধকৌশলের পুনরাবৃত্তি, যেখানে তারা একত্রিত আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করত। তবে এই কৌশলের দুর্বলতা ছিল—একবার পরাজিত হলে তা পুনরুদ্ধারের আর কোনো সুযোগ থাকত না।
যুক্তরাষ্ট্র এই পরিস্থিতিকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগায়। নিমিত্জের অভিযান ছিল মূলত একটি বিভ্রান্তিমূলক আক্রমণ। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে ফরমোজায় প্রতিরক্ষা শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে বাধ্য করে, যার ফলে ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিকল্পনা সফল হয়, এবং মিত্রপক্ষ ফিলিপাইনে সহজেই আক্রমণ চালিয়ে বিজয় অর্জন করে।
এই সাজানো অভিযানের ফলে জাপান ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় প্রায় ৬০০ জাপানি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে ফিলিপাইনে জাপান ইম্পেরিয়াল নেভির আকাশ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার মতো যথেষ্ট বিমান আর অবশিষ্ট থাকেনি।

অবশেষে, ১৯৪৪ সালের ২০ অক্টোবর, যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের লেইট উপসাগরীয় অঞ্চলে নোঙর করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে জাপান তখনও পরাজয় মেনে নেয়নি এবং তাদের শোগো ১ পরিকল্পনা কার্যকর করে চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে।জাপানের নৌবাহিনী একটি কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার লক্ষ্য ছিল প্রথমে আমেরিকানদের লেইট উপসাগরে নোঙর করতে দেওয়া। এই সময় আমেরিকান অ্যাডমিরাল উইলিয়াম হ্যালসি পিছন থেকে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকবেন। জাপানের ভাইস অ্যাডমিরাল ওজাওয়া হ্যালসির বাহিনীর দিকে অগ্রসর হবেন, এবং যখন হ্যালসি তার মোকাবেলায় এগিয়ে আসবেন, তখন ওজাওয়া পিছু হটবেন। এতে হ্যালসির বহর ওজাওয়ার পিছু নেওয়ার জন্য বাধ্য হবে, আর এই ফাঁকে লেইট উপসাগরে অবস্থানরত আমেরিকান সৈন্যদের উপর চূড়ান্ত আক্রমণ চালানো হবে।
জাপানের এই কৌশল প্রায় সফল হতে যাচ্ছিল। তবে লেইট উপসাগরে পৌঁছানোর আগেই আমেরিকান বাহিনী বিমান থেকে জাপানিদের উপর প্রবল বোমা হামলা চালায়। এতে জাপানি বাহিনী উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আমেরিকান সেনারা তীরে নামতে খুব বেশি প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়নি।
২৩ অক্টোবরের প্রথম প্রহরে লেইট উপসাগরে মূল যুদ্ধ শুরু হয়। আমেরিকার নৌবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সম্মুখ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন জাপানের ভাইস অ্যাডমিরাল তাকেও কুরিতা। তার বহরে ছিল ইয়ামাতো, যা শুধু জাপানের নয়, বরং বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ হিসেবে পরিচিত। তবুও, এই শক্তিশালী বাহিনী নিয়েও শেষ পর্যন্ত জাপান পরাজিত হয়।
যদি জাপান এই যুদ্ধে জয়লাভ করত, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হতে পারত। কিন্তু লেইট উপসাগরের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে জাপানের সামরিক শক্তি চূড়ান্তভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এটি মিত্রশক্তির বিজয়কে আরও দ্রুত নিশ্চিত করে। লেইট উপসাগরের যুদ্ধ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড় নৌযুদ্ধ, এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তি এবং জাপানের ইম্পেরিয়াল নৌবাহিনীর মধ্যে সংঘটিত হয়, যেখানে উভয় পক্ষের শতাধিক জাহাজ ও হাজারেরও বেশি বিমান অংশ নেয়। এটি ছিল জাপানের জন্য একটি চূড়ান্ত প্রান্তিক লড়াই, যেখানে তারা আত্মঘাতী “কামিকাজে” কৌশল প্রথমবারের মতো ব্যবহার করে। জাপান মূলত কৌশলগত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিল, কিন্তু আমেরিকান নৌবাহিনীর শক্তিশালী আক্রমণের সামনে তারা টিকে থাকতে পারেনি। এই যুদ্ধ জাপানের পতনের পথ সুগম করে এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মিত্রশক্তির বিজয়কে প্রায় নিশ্চিত করে দেয়।

